একক সাক্ষাৎকার-
হুসনে আরা জলি, ব্যাক্তি জীবনে একজন কবি
লেখক, সমাজ সেবক, নারী অধিকার কর্মী। জীবনের
করুণ মুহূর্ত থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে নারীদের উন্নয়নে কাজ করে
যাচ্ছেন সিরাজগঞ্জের হুসনে আরা জলি। মাত্র
১৩ বছর বয়সে বাল্য বিয়ে হয় তার। এরপর জীবনে নেমে আসে অন্ধকারের ছায়া। কিন্তু, তার জীবনের বেদনাকে
শক্তিতে পরিনত করে পিছিয়ে পড়া হাজারো নারীর জীবনের প্রদীপ জালাতে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি
।
মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্ম তার। পরিবারের তিন ভাই বোনের মধ্যে জলিই সবার
ছোট। বাবা জজকোর্টের
পেশকার (অবসরপ্রাপ্ত), মা গৃহিণী। পরিবারের ছোট হওয়ায় শৈশবটা আদরে কাটলেও কৈশোরে পা দিতে না
দিতেই মাত্র ১৩ বছর বয়সেই বাল্য বিয়ে হয় তার। অসমাপ্ত থেকে যায় লেখাপড়া।সাংসারিক কাজ ও পারিবারিক নানা অত্যাচারের মধ্য দিয়েই দিন পার করতে হয়
তাকে। জীবনে নেমে আসে
কালো অন্ধকার। এরপর সেই
অত্যাচারের বেড়াজাল ছিড়ে চলে আসেন তিনি। নতুন সংসার
শুরু করেন বিশিষ্ঠ সাংবাদিক মোস্তাক আহমেদ নওশাদের সাথে। জীবনের আহবানে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ান তিনি।
স্বামী সাংবাদিক মোস্তাক
আহমেদ নওশাদ এর উৎসাহ অনুপ্রেরণায় মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি অসংখ্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার বিভিন্ন পদে
কাজ করেছেন তিনি। বিভিন্ন
এনজিও তে কাজ করতে করতে শুনতে পারেন সমাজের পিছিয়ে পরা নারীদের করুণ, অমানবিক জীবন গল্প। এগুলো তার মনে
দাগ কাটে ।
তিনি বলেন, সামান্য একটি ২/৩ টাকা
মূল্যের পাউরুটির জন্য যখন মাত্র ১৩ বছর বয়সী মেয়েকে সারারাত ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণেরর
শিকার হতে হয়েছে। সন্তানের খাবারের জন্য মা’কে পতিতা বৃত্তির পথ বেছে নিতে হয়েছে ।
এ রকম হাজারো বেদনা মিশ্রিত গল্প আমার মাঝে নারীদের নিয়ে কাজ করার জন্য শক্তি
জুগিয়েছে। এরপর সিদ্ধান্ত নেই
যে, নারীদের উন্নয়নে কাজ করব।নিজ জীবনের থমকে যাওয়ার সেই মুহূর্ত এবং এই গল্পগুলোর সংমিশ্রণেই গড়ে তুলেছিলেন
“প্রোগ্রাম ফর উইমেন ডেভলপমেন্ট (পি ডাব্লিউ ডি)”।
এভাবে ১৯৯৯ সালে জেলা মহিলা অধিদপ্তরের অনুমতি
ক্রমে চালু করেন প্রোগ্রাম ফর উইমেন ডেভলপমেন্ট (পি ডাব্লিউ ডি)। প্রথমে অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত নারীদের দক্ষতা ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য সেলাই মেশিন ও বুটিক
শিল্পের কিছু সরঞ্জাম নিয়ে প্রোগ্রাম ফর উইমেন ডেভলপমেন্ট (পি
ডাব্লিউ ডি) যাত্রা শুরু করে।
বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি নারী ও
শিশু অধিকার বাস্তবায়ন, নারীর ক্ষমতায়, অপুষ্টি
প্রতিরোধ, প্রতিবন্ধী সেবা, ত্রান ও পূনর্বাসন
সহ প্রায় ৭/৮ টি লক্ষ
নিয়ে কাজ করছে। এমনকি শ্রমজীবী
শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করনের জন্য তারা মুক্তপাঠ নামের একটি কার্যক্রম পরিচালনা করে
আসছেন। এরকম অসংখ্য সমাজ
সেবা মূলক কার্যক্রম করে আসছেন তিনি।
প্রোগ্রাম ফর উইমেন ডেভলপমেন্ট (পি ডাব্লিউ ডি) এর উল্লেখ্য কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে নারীর
অধিকার ও নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরন, দুর্যোগ প্রস্তুতি ও পুনর্বাসন,
বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা,নারীদের আয় বর্ধক কর্মসূচী,
নারীদের মাঝে কম্পিউটার ও অটোমোবাইল সার্ভিসিং, ল্যাকটিং মাদার কেয়ার, কর্মমুখী প্রশিক্ষণ (সেলাই, বুটিক ও কুটির শিল্প), নারীর
প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ, নারী অধিকার, সমাজ
সচেতনতা, পিছিয়েপরা নারীদের সাহায্য ও পুনর্বাসন। জাতিসংঘ মহিলা বিষয়ক সংস্থা (ইউ এন উইমেন) এর সাথেও কাজ করছে (পি ডাব্লিউ ডি) ।
হুসনে আরা জলি বলেন, মাঠ পর্যায়ে
বিভিন্ন শ্রেণীর অসহায় নারীদের নিয়ে কাজ করার সময় তাদের বেদনাদায়ক গল্প আমাকে
নারীদের উন্নয়নে কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত করে। তখন থেকেই পরিকল্পনা গ্রহন করি
সমাজে নারীর অধিকার বাস্তবায়ন, নারীর ক্ষমতায়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, বৈষম্যহীন
সমাজ প্রতিষ্টার, নারীদের আত্ন নির্ভরশীল করার জন্য কাজ করার পরিকল্পনা গ্রহন করি।
জলি তার কাজের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, নারীর প্রতি বৈষম্যহীনতা, নারীর অধিকার ও নারীর নিরাপত্তা
নিশ্চিতকরন, কর্মমুখী প্রশিক্ষণ (সেলাই,
বুটিক ও কুটির শিল্প), নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ,
নারী অধিকার, সমাজ সচেতনতা ও নারীদের আত্ন নির্ভরশীল করে গড়ে
তুলতেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সেলাই, বুটিক ও কুটির শিল্প বিষয়ে
কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং প্রশিক্ষণ পরবর্তী সময়ে আত্ন কর্মসংস্থান করার জন্য ক্ষুদ্র
ঋণ প্রদান করে নারীদের নির্ভরশীল করে গড়ে তুলছি।
“তথ্য প্রযুক্তির সাথে নারীদের সমান তালে
এগিয়ে নিতে আমরা কম্পিউটার ও অটোমোবাইল সার্ভিসিং প্রশিক্ষণ প্রদান করছি।”
কোথাও নারীর ওপর সহিংসতা হলে তা প্রতিরোধে
আমরা সকল প্রকার আইনী সহায়তা প্রদান করতে কাজ করি। শুধু নারীর অধিকারই নয়, নারী ও কিশোরীদের স্বাস্থসেবা
দিয়ে আসছে তিনি, প্রান্তিক এলাকায় চিকিৎসা সেবা, স্বাস্থ্য সেবা ক্যম্পেইন,
কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থসেবা প্রদান ও স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ দিয়ে থাকি।
তিনি আরও বলেন, নারীর পাশাপাশি সমাজের
পিছিয়েপরা সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মধ্যে যারা শিশু অবস্থায় নানা রকম কাজ অর্থাৎ
শিশু শ্রমের সাথে জড়িত তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে আলোর সন্ধান দিতে আমরা “মুক্তপাঠ”
নামে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি । সিরাজগঞ্জে ৪টি
স্থানে আমরা এ কার্যক্রম পরিচালনা করে ৮০ জন শ্রমজীবী শিশুকে পড়াচ্ছি। আগামীতে এই “মুক্তপাঠ”
প্রকল্পটি আরও প্রসার করার পরিকল্পনা আছে আমাদের।
এছাড়াও পথ নাটোক ও নানাবিধ সাংস্কৃতিক
চর্চায় মাধ্যমে মানুষের মাঝে নারী ও শিশু অধিকার সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে
যাচ্ছেন তিনি ও তার সংস্থা।
তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, কিছু
ভালো কাজ করতে যেমন প্রয়োজন আছে ইচ্ছা ও পরিকল্পনার ঠিক তেমনিভাবে প্রয়োজন উপযুক্ত
সহযোগিতার। আমার এই কাজ গুলোতে বিভিন্ন সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা আমাকে পাশে থেকে সহযোগিতা করেছে । এছাড়াও
স্থানীয় সমাজের মানুষদের ভুমিকাও ছিল প্রসংশনীয়।
0 মন্তব্য