মাহীব
রেজা, ঢাকা:
যে সময়ের কথা বলছি, তখন
সবেমাত্র এদেশ থেকে কোম্পানী শাসন শেষ হয়েছে। এদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান। চারিদিকে
কোম্পানী তাড়ানোর স্বস্তি বিরাজ করছিল। বেলা তখন আটটা কি নয়টা হবে।স্টেশনের ঠান্ডা
প্লাটফর্মএ বসে ইটের নুড়ি দিয়ে দাগ কেটে বাঘ-মহিষ খেলছে অহি আর রকি।দুজনেই বছর
বারোর মত হবে।ঢাকায় এসেছে বেশ আগে।স্টেশনটাই ওদের বাড়িঘর, খেলার জায়গা।বলতে বলতে
অহির বাঘ সবগুলো মহিষ গিলে ফেলল।
-অহি! এইডা হইল
ক্যামনে? দুনম্বারি করছস?
-দেখ রকি, তোর চোখের
সামনেই দান দিলাম, এহন এডা কইলে চলব না!
-না রে অহি, এমনেই
কইলাম। তুই যে কত্ত ভালো দান দিছস আমি দেখছি।চল যাই গা!পানির বোতল বেচন লাগব।
ওরা চলে যায়।মেঝের উপর
লাল দাগ কেটে বাঘ-মহিষ খেলার ঘরটা থেকে যায়। কেউ মুছে ফেলে না।
খানিক বাদে ট্রেন এলে
ওদের দুজনকে আবার দেখা যায়। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলছে- "পানি লাগব, পানি...
এক বোতল দশ টেহা"
কিছুদিন পর বেশ উত্তাপ
দেখা দিল আশেপাশে। প্রতিদিন দিনে মিছিল, মানুষের হাতে নানান ব্যানার প্ল্যাকার্ড,
সন্ধ্যায় মশাল মিছিল। এসব 'উত্তাপ' অহি আর রকিকে বেশ মজা দিচ্ছিল।প্রতিদিন ওরা
মিছিলের সাথে অনেকদূর পর্যন্ত হেঁটে যেত।সন্ধার মশাল মিছিল দেখলে মনে হত যেন ঝাঁক
বেঁধে জোনাকি উড়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে ওরা মশাল মিছিলেও গেছে। ভাগ্যিস কেউ জানতে
পারেনি। কেন জানি বাচ্চাদের কেউ মিছিলে যেতে দেয় না।
পরে যখন বোঝা গেল যে,
দাবীগুলো আসলে বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য,তখন অহি আর রকির উৎসাহ বেড়ে গেলো। প্রতিদিন ওরা নিয়মিত
মিছিলের স্লোগানে অংশ নিত।গলা ফাটিয়ে বলত-"নাজিমুদ্দিনের কল্লা চাই!
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই"
একদিন রকি জিজ্ঞেস
করে---
-আচ্ছা অহি, এই
নাজিমুদ্দিন কেডা?
-মনে হয় বড় কেউ হইব।তয়
লোকডা যে ভালা কাম।করতাছে না হেইডা বুঝতাছি।
-হ, ঠিকই কইছস। কহ দেহি
মিছিলের লাগান-'নাজিমুদ্দিনের!নাজিমুদ্দিনের!'
-'কল্লা চাই! কল্লা
চাই'।
এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে
গেলো। মাঝখানে আবার হরতালও ছিলো। গাড়ি চলে নি। ট্রেন চলেছে। তবে লোকজন ছিলো কম।
পানির বোতল বিক্রি হয়েছে হাতেগোনা কয়েকটা।
একদিন সকাল বেলা, বেশ
হট্টগোল চারপাশে।কে জানে শেষ পর্যন্ত কি হবে। রাস্তা র মোড়ে মোড়ে পুলিশের
ব্যারিকেড। হাতে লাঠি।পিঠে বন্দুক।বুটের জুতার খটখট শব্দ।সব শোনা যায়।স্টেশনের
কৃষ্ণচূড়া গাছটা সেদিন লাল টকটকে রঙের ফুল ফুটিয়েছিল।
সারাটা দিন অলসভাবে
কাটল অহি-রকির।ফাগুনের হু হু বাতাসে অহির এলোমেলো চুল নাড়িয়ে দিচ্ছে বারবার।ফিসফিস
শব্দে অহির ঘোর কাটল।তাকিয়ে দেখে চারপাশে বেশ হট্টগোল শুরু হয়েছে।চারদিক থেকে
গুলির শব্দ ভেসে আসছে।কাঁদুনে গ্যাসের ঝাঁঝে চোখ জ্বালা করছে।অহি উঠে দাঁড়ায়।
শক্ত করে রকির হাত ধরে
বলে---
-আমাগো ভাষা কাইড়া
লইব, হে ব্যাটারা আইসা পরছে।
রকি বলে, 'হ! চল পালাই!'
-না! পালামু ক্যান? ভাষা আমাগো
নিজের। আমি অগোরে ডরাই না।
তারপর হঠাৎ স্লোগানগুলো
ভেসে ওঠে অহির মনের ভেতর।" রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই,
নাজিমুদ্দিনের কল্লা চাই"
কৃষ্ণচূড়া গাছটার টকটকে
ফুল তখনো শোভা বাড়িয়ে যাচ্ছিল। অহির অস্থির লাগছে, খুব অস্থির লাগছে।মনের অজান্তেই
ভেতর থেকে স্লোগানগুলো বেড়িয়ে আসে।
স্টেশনের সবাই ওর দিকে
তাকায়।এক মুহুর্তে সব যেন স্থির হয়ে গেছে।
অহি রকির হাত ছেড়ে এক
দৌড় দিল রাজপথে।ফকিরাপুল, পল্টন পেরিয়ে একেবারে টিএসসি তে। ততক্ষণে টিএসসি রণাঙ্গন
হয়ে উঠেছে। একপাশে পুলিশ অন্যদিকে ছাত্রজনতা। অহির হাত মুঠ-বন্ধ হয়ে যায়।
অসীম।সাহস যেন এসে ভর করে তার ভেতর।আবারো উচ্চারিত হয় সেই স্লোগান- রাষ্ট্রভাষা বাংলা
চাই।
হঠাৎ মৌমাছির মতো পোঁ
পোঁ শব্দে সীসার মতো কিছু একটা এসে বিঁধল অহির শরীরে।হাত দিয়ে অনুভব করে সে-- গরম
রক্ত।চোখের মধ্যে ভেসে ওঠে- লাল কৃষ্ণচূড়ার আভা, বাঘ-মহিষের খালি দাগকাটা ঘর,রকির
মুখ......মা কাকে বলে সে জানে না। কাউকে মা বলে ডাকার সুযোগই হয়নি।কিন্তু যবে থেকে
সে শুনেছে ভাষা নাকি আমাদের মা, তবে থেকে সে সেই মায়ের আদর চেয়েছে, স্নেহ
চেয়েছে।সে স্পষ্ট দেখে সমস্ত বর্ণমালা এক মা হয়ে তার কাছে এসেছে।
তার দেহ মাটিতে
লুটায়।রকি দৌড়ে আসে। হাত ধরে বারবার ডাকে,'ওঠ অহি'.... কিন্তু অহি উঠে না।মুখ দিয়ে
এখনো কি যেন বলছে অহি। রকি শোনার চেষ্টা করে।শোনা যায় অহি বলছে--"রাষ্ট্রভাষা বাংলা
চাই", নাজিমুদ্দিনের......
কৃষ্ণচূড়ার লাল আভা
তখনো জ্বলজ্বল। কালো পিচের মধ্যে রক্তে মাখামাখি। হঠাৎই সমস্ত জায়গাটা ভীষণরকম
স্তব্ধ হয়ে যায়। শুধু অহির ঘোলা চোখ দেখে- মা আসছে, এ মা যে বাংলা ভাষা, না এসে
পারে?
0 মন্তব্যসমূহ