মাহীব রেজা,
ঢাকা
রবিবার।২৯ এপ্রিল ১৯৭১।অবস্থা ভালো না।যেখানে সেখানে
গোলাগুলি।পাকিস্তানিরা পাখির মতো মানুষ মারছে।প্রাণ বাঁচাতে সবাই তখন বর্ডারের
দিকে হন্যে হয়ে ছুটছে।গন্তব্য ভারত।
সোনাপুর গ্রামটা বর্ডারের ধারেই।ননীগোপালের ছোট্ট কুটির ছাড়িয়ে
একটু সামনে এগুলেই, একটা মস্ত বটগাছ চোখে পড়ে, ওখান দিয়ে সদর রাস্তা আলপথে
মিশেছে।আলপথটা এঁকে বেঁকে ভারতে গিয়ে ঢুকেছে।
বটগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে মানুষের স্রোত দেখছে একটা ছোট্ট ছেলে,
নাম রাশিক।আমাদের রাশিক তখন ক্লাশ সিক্সে।দেখলে মনে হবে ফোর কিংবা ফাইবে পড়ে।
বটগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে এভাবে জনস্রোত দেখাটা বেশ
অস্বস্তিকর।একে গ্রীষ্মকাল।আকাশে গনগনে সূর্য।তার উপর মানুষগুলোর চোখেমুখে
আতংক।এভাবে মানুষকে দেখলে অন্যরকম লাগে।মন খারাপ হয়ে আসে। জানোই আমাদের রাশিক
অন্যদের মতো না।তাই সে গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখছে।হাজার হাজার
মানুষ।লাইন ধরে চলেছে, ঠিক পিঁপড়া যেমন চলে,তেমন।কত কে চলেছে।রাশিকের মতো
ছোটরাও।মুখ শুকনো সবারই।দেখলে মনে হবে কত দিন যে ওরা কিছু খায়নি।
এমন সময় হঠাৎ রাশিকের চোখে পড়ল, প্রবল জনস্রোতের মধ্যে থুড়থুড়
এক বৃদ্ধ লাঠি ভর দিয়ে যাচ্ছে।দেখে বোঝা যাচ্ছে, অনেকদূর হেঁটে এসেছেন।চোখেমুখে
ক্লান্তি।মুখ ভরা সাদা দাড়ি।গরমে তিনি ঘামে ভেজা।তারপরো তিনি এগিয়ে চলেছেন।রাশিক
ভাবে, জীবনের শেষে এসেও বেঁচে থাকার কত তাগিদ মানুষের।
রাশিক তাকে ডেকে গাছতলায় এনে বসাল।ননীগোপালের কুটির থেকে তার
জন্য এক গ্লাস পানি, দুটো বেকারী কুকিজ আর খানিকটা বাতাসা এনে দিল রাশিক।বৃদ্ধ
সাগ্রহে খেল সবটা।কত দিন পর যেন খাবার পড়ল পেটে।
কিছু সময় অবাক হয়ে রাশিকের দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি।এ সময়টা
রাশিকের বেশ অস্বস্তি লাগে।কেউ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে কেমনজানি লাগে।
ঘোর ভাঙলে বৃদ্ধ হু হু করে কেঁদে ফেললেন।সাদা দাড়িগুলো দিয়ে
চোখের পানি পড়তে লাগল।বারবার তিনি রাশিকের মুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
কে জানে, হয়ত রাশিকের মতই তার একটা নাতি ছিল,হয়ত সে দাদুর হাত
ধরে বাজারে যেত,নানা জিনিস কেনার বায়না করত।কে জানে, হয়ত ওই নাতিটাকেও মিলিটারি
মেরে দিয়েছে।পূব গ্রামের লোকজন বলাবলি করছিল, কোথায় নাকি বাবার সামনেই ছেলেকে জবাই
করেছে।ইশ! কি নিষ্ঠুর!ভাবলেই রাশিকের গায়ে কাঁটা দেয়।
খানিক বাদে, রাশিক জিজ্ঞেস করে-'কাঁদছেন কেন?'
বৃদ্ধ বলে,"আমার ছেলেকে ওরা ধরে নিয়ে গেল,আমি কিচ্ছু
বলিনি।ছেলেমানুষ-মরলে দেশের জন্য মরবে"
রাশিক বলে,"তবে কাঁদছেন কেন?"
বৃদ্ধ কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন।তারপর
বললেন,"দেশের জন্য যুদ্ধে যাইতে পারলাম না বাবা,শশীরে সয় না"
কথাটা শুনে রাশিকের গায়ে আবার কাঁটা দেয়।অসম্ভব এক সাহস এসে ভর
করে বুকের মধ্যে।সে সাহস কেউ দেখেনি,কিন্তু আমি জানি সেটা আগুনের ফুলকির মতো,একটু
বাতাস পেলেই গনগনিয়ে উঠবে।
0 মন্তব্যসমূহ