শীতের সকালে একদিন
নিলুফার জাহান
অধ্যাপক ইংরেজি বিভাগ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ,ঢাকা
'মা, মাগো, একটু
খাবার দেন না?
খুব খিদে পেয়েছে!'
আজ খুব শীত পড়েছে। সকাল হয়েছে কিন্তু সূর্যের দেখা নেই। কুয়াশা ঢাকা রাস্তা ঘাটে। এই
শীতের সকালে থর
থর করে কাঁপতে কাঁপতে
খাবার খুঁজছে এক
বয়স্ক মহিলা।
পরনে জীর্ণ শীর্ণ
একটা শাড়ি।
গায়ে একটা গরম
কাপড় নেই।
এক হাতে একটা লাঠি। আরেক হাতে ভিক্ষার বাটি।
চেহারাটা খুব সুন্দর। গাঁয়ের রঙটাও ফর্সা কিন্তু চেহারাটা
মলিন , না খাওয়া মানুষের মতো।
পায়ে এক জোড়া
ছেঁড়া জুতা।
রমিসা বেগম নাস্তা
তৈরি করছিলেন।
তার সাথে একটা
অল্প বয়সী মেয়ে কাজে সাহায্য করছে।
ওদিকে অফিসে যাচ্ছেন
আতিক সাহেব।
যদিও ছেলের মেয়েদের
জন্য নাস্তা তৈরি জামা কাপড় ব্যাগ গুছিয়ে দেয়া, স্কুলে পাঠানো এসব কাজের তাড়া নেই।
তবুও রমিসার চোখে
মুখে এক রাশ বিরক্তির ছাপ!
'এতো সকালে ভিক্ষুকের
জন্য খাবার দিতে হবে?'
যত্তোসব ঝামেলা
কোথ্বেকে যে আসে?' মনে মনে বললেন।
এদিকে ছেলে মেয়ে
দুজন মানিক আর মিলা ঘুম থেকে উঠে পড়েছে।
ওদের এখন স্কুল
নেই। নাস্তা খেয়ে
পড়তে বসবে।
অন লাইনে ওদের
ক্লাস করতে হয় ।পড়া শিখতে হবে
ক্লাস শুরু হওয়ার
আগেই। মানিক ক্লাস ফোরে
আর মিলা ক্লাস থ্রীতে পড়ে। ওদের মনে অনেক
কষ্ট । ঘরে বসে ক্লাস
করতে ভালো লাগে না ওদের।
কতদিন আর ঘরে বসে
থাকবে? বন্ধু বান্ধবদের সাথে দেখা হয় না আগের মতো।
সবাই মিলে মাঠে
গিয়ে খেলতে পারে না। আগের মতো ছুটোছুটি দৌড় ঝাঁপ করতে পারে না।
করোনা জীবের কারণে
শুধু ঘরের ভেতর থাকতে হয়।
হঠাৎ শোনা যাচ্ছে
,
কেউ একজন খাবার
চাইছে
দুজনেই দেখে এতো
শীতে জীর্ণ শীর্ণ কাপড়ে মলিন মুখে
এক বৃদ্ধা মহিলা
দরজায় দাঁড়িয়ে।
মানিক ও মিলার
মন আরো খারাপ হয়ে গেল।
মানিক ও মিলা ছুটে
গিয়ে নিজেদের খাবার থেকে কিছু খাবার এনে বৃদ্ধা মহিলাকে এনে দিলো।
একটু খাবার দেখে
বৃদ্ধার চোখে মুখে হাসি
ফুটে উঠল! সে একবার
মানিকের দিকে তাকায় আবার
খাবারের দিকে।
বৃদ্ধার কাছে এসে
ওরা বলল, 'খেয়ে নিন'
বৃদ্ধা খাবার দেখে
দু'হাত তুলে দোয়া করল
''আল্লাহ্ আপনার
সব আশা পূর্ণ করব'
ধন সম্পদ দিবো।"
এমন সময় ওদের
মা এলেন। ভীষণ রাগ করলেন
মানিক আর মিলার
উপর। 'নিজেরা নাস্তা
না খেয়ে সব এই বৃদ্ধাকে দিয়ে দিলে তোমরা?'
'মা, একদিন একটু
কম খেলে কিছু হবে না। আমরা তো প্রতিদিন
ভালো খাবার খেতে পাই।
এই মহিলা তো তিনটা
দিন ধরে কিছুই খেতে পায়নি ।
মা, একটা চাদর দিয়ে দাও না এই মহিলাকে?
দেখো না শীতে কাঁপছে!
একটা চাদর দিয়ে
দাও না , মা! তোমার তো অনেক চাদর আছে।
''
'চাদর থাকলেই কি
দিয়ে দিবো?
মহিলা এখান থেকে
খাবার পেয়েছে আরেক বাসা থেকে
চাদর নিবে। সে তো বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়'।'
বৃদ্ধা মহিলাটা
এবার কেঁদে দিলো । 'মা, আমি বাড়ি
ঘুইরা বেড়াই না।
আইজ কত দিন ধইরা
ঘরে খাওন নাই।
আমার পোলা আগে
একটা কোম্পানিতে কাজ করতো!
অনেক ভালো চলছি। কিন্ত্তুক পোলার অহন চাকরি চইলা গেছে। কি জানি একটা অসুখ আইছে দেশে
এর লাইগ্গা । অনেক জনরে একসাথে বিদায় কইরা
দিছে । অহন কাম নাই, ঘরে খানা নাই, কাপড় নাই। অনেক দিন কষ্টে মষ্টে চলতাছি।
ঘরের জিনিস বিক্রি
করছি অনেক।
কোনমতে এক বেলা
খাইছি আরেক বেলা উপাস থাকছি।
খিদা আর সহ্য করতে না পাইরা আইজই বাইর হইছি।
আমার পোলাও কাম
খুজতাছে। কাম পাইলে আর
চাইতে আসুম না। '
একটু খানা খাইছি। থাক চাদর লাগবো না।'
বৃদ্ধার কষ্টের
কথা শুনে রমিসার মনে দয়ার সৃষ্টি হলো।
তিনি বললেন, তুমি
একটু দাঁড়াও আমি আসছি।
এই বলে ঘরে গেলেন।
ওয়ার্ডরোব থেকে
একটা ভালো চাদর এনে মহিলার গায়ে জড়িয়ে দিলেন।
এই নাও এমন শীতে ঠান্ডা লাগিয়ো না। সাবধানে চলাফেরা করো। মায়ের এমন সুন্দর কোমল আচরণ দেখে মানিক
আর মিলা
দু'জনেই খুশিতে
হাততালি দিয়ে উঠলো।
তারপর রমিসা নিজের ছেলে মেয়ের এমন উদার মনোভাবের জন্য আল্লাহর
কাছে শুকরিয়া করলেন।
আমার ছেলে মেয়েরা আমার চোখ খুলে দিয়েছে।
ওরা দুজনই সত্যিকার
অর্থে ভালো মানুষ হচ্ছে!
দু'জনকে জড়িয়ে
ধরে আদর করলেন মা রমিসা।
রমিসার চোখে খুশিতে
যেন পানি এসে গেল।
বৃদ্ধা মহিলাটাকে
ডেকে বললেন,'
'চাদরটা ভালো করে
গায়ে জড়িয়ে নাও। ঠান্ডা পড়েছে
খুব। বাইরে বেশি থেকো
না। রান্না ঘর থেকে
একটু খাবার এনে দিয়ে বললেন,
"এই খাবারটা
তোমার ছেলের জন্য নিয়ে যাও।
তোমার খিদে পেলে
এসে খেয়ে যেও ।
আগামীকাল সকালে
তোমার ছেলেটাকে নিয়ে এসো
মানিকের বাবার
সাথে দেখা করো ।
দেখি কোনো কাজ
দেয়া যায় কিনা !'
বৃদ্ধার চোখে মুখে
খুশির রেখা ফুটে উঠলো।
'এমন হইতো যদি
সবাই সবার পাশে থাকতো'!
বৃদ্ধা মহিলা বলে
উঠলো।
0 মন্তব্যসমূহ