একক সাক্ষাৎকারঃ সিরাজগঞ্জে ২০৩টি বাল্য বিয়ে বন্ধ করে রেকর্ড গড়লেন এসিল্যান্ড
Admin
প্রকাশের সময় : ২৬/০১/২০২০, ৯:১২ AM
শিশু বার্তা ডেস্কঃ
সামাজিকব্যাধি বাল্য বিয়ে যখন বাধাগ্রস্থ করছে সমাজের এগিয়ে চলা। তাড়া করে বেড়াচ্ছে প্রতিটি কিশোরীর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে। সমাজ যখন সেকেলে ব্যাধি বাল্যবিয়েকে পাশকাটিয়ে উঠতে পারছে না। ঠিক তখন সিরাজগঞ্জ সদরের সকল কিশোরীর জীবনে নিরাপত্তার প্রদীপ হাতে বাল্যবিয়ে বন্ধে কাজ করে যাচ্ছেন সিরাজগঞ্জ সদরের এসিল্যান্ড মো. আনিসুর রহমান দিন রাত এক করে একাধারে বাল্যবিয়ে বন্ধ্যে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি । যখন ৫ম শ্রেণীর একজন কিশোরীও বাল্যবিয়ের ভয়ংকর থাবা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না তখন তখন তাদের পাশে দাড়িয়েছেন তিনি।
এমন সময় সিরাজগঞ্জে সকল কিশোরীর পাশে দড়িয়েছেন এসিল্যান্ড মো. আনিসুর রহমান। তিনি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা ও যমুনা বিধৌত চৌহালী উপজেলার এসিল্যান্ড (সহকারী কমিশনার ভূমি) দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।সকাল কিংবা গভীর রাত, শহর কিংবা গ্রম, কখনো আবার নদী বিধৌত চরাঞ্চলেও বাল্যবিয়ের খবর পেলেই ছুটে চলে যান তিনি। এসিল্যান্ড হিসেবে কর্মরত এই কর্মকর্তা সিরাজগঞ্জে দায়িত্ব পালনের ২২ মাসের মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ২০৩ টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছেন। বাল্য বিয়ে বন্ধ্যের এই রেকর্ড নজিরবিহীন বলে দাবি করছেন অনেকেই।
সিরাজগঞ্জ জেলার মানুষের কাছে আইন বাস্তবায়নকারী একজন সফল ব্যাক্তির নাম আনিসুর রহমান। তিনি তার দায়িত্ত্বের জায়গা থেকে শুধু বাল্যবিয়ে নয়, বেশ ক’টি শিশু অধিকার বাস্তবায়ন ইস্যুতে কাজ করেছেন তিনি। তার ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার ইস্যু গুলোর মধ্যে উল্লেখ্য ছিল বাল্যবিয়ে, ইভটিজিং, খাদ্যে ভেলাজ (শিশুদের অপুষ্টি দুরিকরণে), মাদক, কিশোর গ্যাং। এর মধ্যে বাল্যবিয়ে ছিল অন্যতম একটি ইস্যু।
কলম সৈনিক প্রতিবেদককে দেওয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২০৩টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছি। তিনি প্রথমে সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসিল্যান্ড হিসেবে যোগদান করি এবং সেখান থেকেই সিরাজগঞ্জ জেলায় বাল্যবিয়ে বন্ধ্যের কাজ শুরু করি এরপর সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা ও চৌহালি উপজেলার ভুমি কমিশনার হিসেবে যোগদান করি। সেখান থেকে সিরাজগঞ্জেও বিভিন্ন স্কুল কলেজে গিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের বাল্য বিয়ে সম্পর্কে সচেতন করে আসি এবং আমার ফোন নাম্বার দিয়ে আসি এবং স্থানিয় লোকদের কাছেও আমার মুঠফোন নাম্বার দিয়ে আসি।
এরপর থেকে যেখানেই বাল্যবিয়ে হয় সে এলাকার শিশু-কিশোর সহ স্থানীয় সমাজসচেতন ব্যাক্তিরা আমাকে আমাকে ফোন কলের বা ম্যাসেজের বিষয়টি মাধ্যমে জানায় । এবং আমি এবং আমার সহযোগী স্টাফদের আন্তরিক সহযোগীতায় দ্রুততার সাথে ঘটনাস্থলে চলে যাই। এবং ঘটনা স্থলে গিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে বর কনের অবিভাবককে দন্ডিত করি এবং একই সাথে ১৮ বছরের আগে বিয়ে দেবে না বলে মুচলেকা নেই । আমাদের এই অভিজান পরিচালনায় বিশেষ ভাবে যাদের কথা না বললেই নয় আর্ম পুলিশ ব্যাটলিয়ান ও পুলিশ সদস্যরাও আমাদের সাথে সক্রিয় ও সচেষ্ট অংগ্রহন করে ।
বাল্যবিয়ে বন্ধ্যের সময় স্থানীয় সমাজের ভূমিকা প্রশংশনীয় থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাকে প্রতিকুল পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এর কারন হচ্ছে আমাদের সমাজের নিম্নবিত্ত ও অসচেতন শ্রেণীর মানুষেরা মনে করেন মেয়েকে বিয়ে দিলেই তারা বেচে যাবেন, বাল্য বিয়ে দেয়া যে একটি অপরাধ এ বিষয়টি তারা বোঝার চেষ্টা করেন না। সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিকুল পরিবেশ এর সম্মুখীন হতে হয়।
সামাজিক সমস্যা তো আরও অনেক ছিল কিন্তু সবকিছুর মধ্যে বাল্য বিয়ে বন্ধ্যে আপনার এত সক্রিয়তা কেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাল্য বিয়ে বন্ধ্যে এতটা জোড় দেওয়ার পেছনে আমার কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে । দেশের মোট জনশক্তির অর্ধেক হলো নারী । কিন্তু আমরা যদি এই নারী শক্তিকে শিক্ষিত ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে না পারি তবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এস.ডি.জি-২০৩০) পূর্ণ হবে না। শুধু তাই নয় এ বাল্য বিয়ের ফলে একটি শিশু স্বপ্ন মাটিচাপা দেওয়া হয়। স্বাস্থঝুকি তো থাকেই। আর সমাজ থেকে বাল্য বিয়ে নির্মূল করতে পারলে নারীরা আর বোঝা থেকবে না তারা জনসংখ্যা থেকে জন শক্তিতে রুপ নিয়ে দেশ ও দশের সেবা করতে পারবে, মাতৃ মৃত্যু কমে যাবে, শিশু মৃত্যু কমে যাবে , নারীর ক্ষমতায়ন বাস্তবায়িত হবে।
কিশোরীদের বাল্য বিয়ের পেছনে কারন হিসেবে অনেকটা বিবেচিত বিষয় হলো ইভটিজিং ও যৌন হয়রানি , বাল্য বিয়ে বন্ধ্য করলেও এর পাশাপাশি কিশোরীদের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রশাসনের ভূমিকা কি? এ সময় তিনি বলেন, আমি ইভিটিজিং এর বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিজান পরিচালনা করেছি ।ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে অনেককে জেল জরিমানা করেছি।এমনকি স্কুল ছুটির সময় আমি নিজে ছদ্মবেশে বালিকা বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে অবস্থান করি এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহণ করি ।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বিষ্ময়ের বিষয় এই যে অনেকগুলো মেয়ে তাদের নিজেদের বাল্যবিয়ে নিজেরাই বন্ধ করেছে ।
বাল্য বিয়ের তথ্যগুলো কোথায় থেকে এবং কিভাবে আসে? এসময় তিনি বলেন, আমি জেলার ৪০–৪৫ টি বালিকা বিদ্যালয় ও কম্বাইন্ড স্কুলের বাল্য বিবাহ নিরোধ কমিটি করে দিয়ে এসেছি। এবং সাথে আমার মোবাইল নাম্বার ও জাতীয় জরুরী সেবার নাম্বার গুলো তাদের কাছে দিয়ে এসেছি । যখন এমন কিছু ঘটনা ঘটে তখন তারা আমাকে ম্যাসেজ বা ফোন কলের মাধ্যমে জানায় । আমি তাথক্ষনিক অভিজান পরিচালনা করি ।
কিন্তু মাঝে মাঝে প্রতিকুলতার মধ্যেও আমাকে অবস্থান করতে হয়েছে । যে শিশুটির বিয়ে বন্ধ করতে যেতাম কখনো তাদের বাবা মায়ের চোখের পানি আর্তনাদ ও নানাবিধ প্রস্তাব আমাকে হার মানায়নি। আমি আইনের প্রটি সচেষ্ট থেকেছি সবসময়।
আর যখন ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করেছি তখন যে মেয়েদের বিয়ে বন্ধ করেছি তাদের কাছে ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল পেতাম । কারো মাঝে হয়ত মুক্তির আনন্দ । আবার কারো মাঝে থাকত অসন্তুষ্টির বহিঃপ্রকাশ। এর কারন হিসেবে তিনি বলেন, পরিবারের দারিদ্রতা, অসচ্ছলতাসহ নানাবিধ বিষয়।
সাক্ষাৎকারে দেয়া একটি পরিসংখ্যানে তিনি জানান, চৌহালী উপজেলায় কর্মকালীন ৩৩ সপ্তাহে ৩৪ টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেন। এরপর বদলি হয়ে আসেন সদর উপজেলায় সহকারী কমিশনার(ভূমি) হিসেবে। এখানে সাড়ে ১২ মাসে ১৬৯ টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেন। ইতোমধ্যে একদিনে ০৭ টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করে অনবদ্য রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এরমধ্যে পৌরসভায় ৩২টি, ইউনিয়ন পর্যায়ে খোকশাবাড়ীতে ১১টি, সয়দাবাদে ১৬টি, কালিয়া হরিপুরে ১৯টি, বাগবাটিতে ২৬টি, রতনকান্দিতে ২৯টি, বহুলীতে ১৩টি, শিয়ালকোলে ১০টি, ছোনগাছায় ১০টি, কাওয়াখোলায় ০৩টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করা হয়। এদের মধ্যে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী ০৪ জন,৪র্থ শ্রেণির ০২ জন, পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ০৬ জন, ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ১০ জন, সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ২১ জন, অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ৫৮ জন, নবম শ্রেণির ছাত্রী ৩৭ জন, দশম শ্রেণির ছাত্রী ২৭ জন,একাদশ শ্রেণির ০৪ জন।সিরাজগঞ্জ সদরে ২০১৯ সালে জানুয়ারী মাসে ০২ টি,ফেব্রুয়ারী মাসে ০২ টি,মার্চ মাসে ১০ টি,এপ্রিল মাসে ২২ টি,মে মাসে ০৮ টি,জুন মাসে ১৫ টি,জুলাই মাসে ১৭ টি,আগস্ট মাসে ২৭ টি,সেপ্টেম্বর মাসে ২৩ টি,অক্টোবর মাসে১৭ টি,নভেম্বর মাসে ১৬ টি,ডিসেম্বর মাসে ০৫ টি এবং জানুয়ারী‘২০২০ মাসে ০৫ টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেন এসিল্যান্ড আনিসুর রহমান।
তিনি আরও জানান, বাল্যবিবাহ বন্ধে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলায় বার লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় এবং ০৬ (ছয়) জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে বর ও কনের বাবার মুচলেকা নেয়া হয়। তিনি চৌহালী উপজেলায় ৩৪ টি ও সদর উপজেলায় ১৬৯টি সহ মোট ২০৩ টি বাল্যবিবাহ নিজে উপস্থিত হয়ে বন্ধ করেছেন।
তিনি বলের আমার এই বাল্যবিয়ে নির্মূললের কাজে স্থানীয় সমাজের ভূমিকা ছিল প্রসংসনীয়, শুধু তাই নয় সিরাজগঞ্জ সদরের মাননীয় জাতীয় সংসদ সদস্য (সদর–কামারখন্দ) অধ্যাপক ডা. হাবিব মিল্লাত মুন্না এম.পি মহোদয় নিজেও আমাকে বাল্য বিয়ের তথ্য পেলে সন্ধ্যান দিয়ে থাকেন। এবং সিরাজগঞ্জ সদরের বাকি অংশ সদর কাজিপুর) এর মাননীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মো. নাসিম (এম.পি) তিনিও আমাদের কাজে সহযোগিতা করেন এবং আমার কাজের প্রসংসা করেন ।
এসিল্যান্ড আনিসুর রহমান জানান, আমাদের এই পথচলা এতটা সহজ ছিল না। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, থানা, আর্ম পুলিশ ব্যাটলিয়ান স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আমাদের ছোট ছোট স্কুলগামী ছাত্রছাত্রী সহ সকলের সার্বিক সহযোগীতায় আমাদের এই কাজগুলো পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা ইতোমধ্যেই বাল্যবিয়ে অনেকটা কমিয়ে এনেছি। সকলের এই সহযোগিতা অব্যহত থাকলে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলাকে বাল্য বিবাহ মুক্ত ঘোষণা করতে পারব।
শুধু মেয়েদের বিয়ে বন্ধ্য করেই ক্ষান্ত হননি এই কর্মকর্তা, লেখাপড়ায় আগ্রহী ও দরীদ্র পরিবারের ৩ জন মেয়ের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, আমার দায়িত্ত্বে এখন তিনজন মেয়ে আছে যাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, একজন মাওলানা ভাষানী বিজ্ঞাণ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এ লেখাপড়া করছে।
এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রার টার্গেটগুলোর অন্যতম বাল্যবিয়ে বন্ধে তার এ অর্জন ইতিবাচকভাবে দেখছে জেলা প্রশাসন সিরাজগঞ্জ। এজন্য ২০১৯ সালের ২৩ জুন আন্তর্জাতিক পাবলিক সার্ভিস দিবসে সদরের এই সহকারী কমিশনার(ভূমি)কে বাল্যবিবাহ বন্ধে অবদান রাখায় বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক কামরুন নাহার সিদ্দীকা।এসিল্যান্ড আনিসুর রহমানের এই সমাজসেবামুলোক কাজকে স্বাগত জানিয়েছে শিশু কিশোর সংগঠন স্থানীয় সমাজসেবক সহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ।
Post Views:
110
আপনার মতামত লিখুন :