সম্পাদকীয়: আর না হোক এমন মৃত্যু, সড়কে না ঝড়ুক শিশুর প্রাণ


দ্বীন মোহাম্মাদ সাব্বির, সম্পাদক ও প্রকাশক, শিশু বার্তা : প্রকাশের সময় : ২৭/০৮/২০২২, ১২:২১ AM
সম্পাদকীয়: আর না হোক এমন মৃত্যু, সড়কে না ঝড়ুক শিশুর প্রাণ

সড়ক দূর্ঘটনায় আমার ভাইবোনদের মৃত্যুর সংবাদ আর ছাপাতে চাই না। এমন সংবাদ সম্পাদনা করতে আমার এক বিন্দুও ভালো লাগে না। ওদের মৃত্যুর সংবাদ, ছবি, ভিডিও ফুটেজে থাকা বাবা-মা ও স্বজনদের কান্না আমাকে অনেক কষ্ট দেয়। আমার মত সব সম্পদকদের জন্যই হয়ত বেদনার মর্মন্তুদ এই অনুভূতি মেনে নেয়া ভীষণ কষ্টের। শিশু বিষয়ক বাংলা সংবাদ মাধ্যম ও শিশুতোষ ম্যাগাজিন শিশু বার্তা ওয়েবসাইটের টপ ৪টি নিউজের ৩ টিতে গত দু’দিনে সড়ক দূর্ঘনায় ৩ শিশুর মৃত্যুর সংবাদে ছেয়ে গেছে। এ চিত্রটি পুরো শিশু বার্তা নিউজ টিম ও পাঠকদের ভিষণ কষ্ট দিয়েছে। ‘আর না হোক এমন মৃত্যু, সড়কে না ঝড়ুক শিশুদের প্রাণ’।
গত ১৯ মে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ি, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ৬৭৪ শিশু নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে ১ মাস থেকে ৫ বছর বয়সি শিশু নিহত হয়েছে ৩৩৭ জন (২০.১৩%), ৬ বছর থেকে ১২ বছর বয়সি শিশু নিহত হয়েছে ৭৫৪ জন (৪৫.০৪%) এবং ১৩ বছর থেকে ১৮ বছর বয়সি শিশু নিহত হয়েছে ৫৮৩ জন (৩৪.৮২%)।
যাদের প্রত্যেকের ছিল নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার। নিরাপদের বিদ্যালয়ে গিয়ে স্বপ্নের পথে হাতছানি দেবার এক সমুদ্র আশা। মর্মান্তিক এই সড়ক দুর্ঘটনায় নিভে যায় এই শিশুদের সমস্ত স্বপ্ন ও সম্ভাবনার প্রদীপ। সেই সাথে ম্লান হয় বাবা-মার সব প্রত্যাশা।
এই শিশুদের মৃত্যুর পর আমরা হয়ত কামনা করি ওরা ওপারে ভালো থাকবে। ওদের যে আমরা এপারে সুরক্ষিত রাখতে পারলাম না, এর দায় নিয়ে কেউ ভাবি না! ওদের এই মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য কে দায়ি কিংবা পরোক্ষ ভাবে আমরা নিজেরাও দায়ি কি না সে বিষয়ে কারো কোন মাথাব্যাথা নেই। আমাদের সড়ক-মহাসড়ক কি নিরাপদ ! যাত্রি-পথচারিদের সুরক্ষার এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কে নেবে তাহলে? সড়ক ও সড়ক পরিবহন খাতে অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যের কারণে শিশুদের অস্বাভাবিক এই মৃত্যু আপনাকে এবং আমাকে সমানভাবে দায়ি করছে না তো? তবে কি হবে হবে আমাদের।
আমরা নিজ নিজ পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে কতটুকুইবা করছি নিরাপদ ও সুরক্ষিত সড়কের জন্য । আমি যদি হই গণমাধ্যমকর্মী তাহলে হয়ত সড়ক পরিস্থিতি নিয়ে উপযুুক্ত সংবাদ আমি করছি না, যদি হই প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা তাহলে আমার প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে বেশ ঘাটতি রয়েছে, যাদি হই পরিবহন চালক কিংবা শ্রমিক তবে আমার দায়িত্ব পালনে অবহেলা রয়েছে, যদি হয়ে থাকি আইন প্রনেতা কিংবা জনপ্রতিনিধি তাহলে আমার আইনে প্রনয়নে সংস্কারাভাব অথবা উপযুক্ত বাস্তবায়ন জটিলতা রয়েছে। এমন অনেক ব্যক্তি, দপ্তর এবং সংস্থা অনেকের ওপর দায়িত্ব রয়েছে এই সড়ক মহাসড়ককে নিরাপদ রাখার। হয়ত কিছু বাঁধা বিপত্তি নতুবা দাপ্তরিক জটিলতাই প্রত্যেকের উপযুক্ত পেশাদারিত্বের যথাযত প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাঁধার সৃষ্টি করছে।
তাহলে হয়ত নিজ দায়িত্ব অবহেলার কথাটুকুকে ঢাকতে দাপ্তরিক জটিলতাকেই মোটাদাগে কারণ হিসেবে সামনে আনব আমরা। এতে হয়ত আপনি কিংবা আমি নিজেকে ক্ষনিকের জন্য বাঁচালাম। কিন্তু, এই যে শিশুটি সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে তার মৃত্যূর জন্য কি আপনি কিংবা আামাকেও দন্ডিত করা উচিৎ নয়? আথবা যে বা যারা আমাদের পেশাদারিত্বের উপযুক্ত প্রয়োগের পথে বাঁধা সৃষ্টি করছে তাদেরকে আরও বেশি শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন নয় কি ?
একে অন্যের প্রতি দোষারোপ করা সহজ কাজ হলেও এখন সময় এসেছে সঠিক ব্যবস্থাপনার। আমরা অনেক বিলম্ব করেছি, অনেক ক্ষতি করেছি নিজেদের। এক্ষেত্রে সব জটিলতাকে দুরে ঠেলে দিয়ে সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় নিরাপদ সড়কের বিষয়ে সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার কাজটি এখন থেকেই শুরু হওয়া প্রয়োজন।
ক্ষেত্র বিশেষে বিশ্লেষণ বলছে, গত ২৮ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় শিশু মৃত্যুর ঘটনায়, বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রী হিসেবে নিহত হয়েছে ৩৩১ শিশু, যা মোট নিহতের ১৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ। রাস্তা পারাপার ও রাস্তা ধরে হাঁটার সময় যানবাহনের চাপায়/ধাক্কায় নিহত হয়েছে ১০২৭ শিশু, যা মোট নিহতের ৬১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ট্রাক-পিকআপ, ট্রাক্টর, ড্রাম ট্রাক ইত্যাদি পণ্যবাহী যানবাহনের চালক ও সহকারী হিসেবে নিহত হয়েছে ৪৮ শিশু, অর্থাৎ ২ দশমিক ৮৬% এবং মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী হিসেবে নিহত হয়েছে ২৬৮ শিশু, অর্থাৎ ১৬শতাংশ।
সড়কপথ বিশ্লেষণ অনুযায়ি দেখা যায়, মহাসড়কে নিহত হয়েছে ২৮৭ শিশু (১৭.১৪%), আঞ্চলিক সড়কে নিহত হয়েছে ৩২৮ শিশু (১৯.৫৯%), গ্রামীণ সড়কে নিহত হয়েছে ৮৮৯ শিশু (৫৩.১০%), শহরের সড়কে নিহত হয়েছে ১৪৭ শিশু (৮.৭৮%) এবং অন্যান্য স্থানে নিহত হয়েছে ২৩ শিশু (১.৩৭%)।
এই পরিসংখ্যানগুলো থেকে যদি ব্যখ্যা করি তাহলে দেখছি, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় শিশু মৃত্যুহার উদ্বেগজনক পর্যায়ে। সড়ক ও সড়ক পরিবহন খাতে অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যেই এসকল সড়ক দুর্ঘটনায় শিশুর মৃত্যুর জন্য দায়ি। রাস্তা পারাপার ও রাস্তা ধরে হাঁটার সময় যানবাহনের চাপায়/ধাক্কায় নিহত হয়েছে ১০২৭ এর অর্থ রাস্তায় জেব্র ক্রসিং ছিল না, থাকলেও পরিবহন চালক সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন না, অথবা পথচারি চলাচলের মত রাস্তা তৈরী করা ছিল না সেখানে। যানবাহনের চালক ও সহকারী হিসেবে নিহত হয়েছে ৪৮ জন শিশু।
এক্ষেত্রে সড়ক পরিবহন খাতে চরম অব্যবস্থাপনা দৃশ্যমান। কারণ, ১৮ বছরের নিচে কাউকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয় না রাষ্ট তাহলে সেই শিশুটি গাড়ির চালক হিসেবে কাজ করা বে-আইনি এবং যদি যানবাহনের সহকারি হিসেবে শিশুদের বিবেচনা করি তাহলে সেটি শিশুশ্রমের আওতায় পড়ে, এক্ষেত্রেও আইন অবমাননার বিষয় দৃশ্যমান। এছাড়াও সড়কপথ বিশ্লেষণ অনুযায়ি দেখা যায়, উপযুক্ত সড়ক ব্যবস্থাপনার অভাব ও অসচেতনতার অভাবে মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক, গ্রামীণ সড়ক সহ শহরের সড়কগুলোতেও সড়ক দূর্ঘটনায় শিশুদের প্রণহানি হয়।
চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হলে চিকিৎসককে দায়ি করা হয়। তেমনিভাবে সড়ক ও সড়ক পরিবহন খাতে অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যের জন্য কারো মৃত্যু হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই দায়ি। শুধু দায়-দোশারপ নিয়ে থেমে থাকলে সড়কে মৃত্যুরহার কমানো সম্ভব হবে না। সকল দপ্তর, পত্রিষ্ঠান, সংস্থা, ব্যক্তিগত জায়গা থেকে সড়ক ও সড়ক পরিবহন ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সড়ক দূর্ষটনা রোধে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তাহলে হয়ত সড়কে শিশুর মৃত্যুর হার হ্রাস করা সম্ভব হবে। আর পত্রিকার পাতা, টিভির বুলেটিন, জাস্ট ইন কিংবা টিকারে লেখা হবে না সড়ক দূর্ষটনায় মৃত্যুর সংবাদ। টিভির পর্দায় দেখতে হবে না সন্তানহারাদের আর্তনাদ। খালি হবে না মায়ের বুক। তাই শিশুদের জন্য নিরাপদ ও বাসযোগ্য পৃথিবী বিনীর্মান করতে নিরাপদ সড়ক পথ নিশ্চিত করে সড়কে শিশুর প্রানহানি প্রতিরোধ করতে সবাইকে কাজ করতে হবে। সড়ক মহাসড়ক কিংবা অঞ্চলিক সড়কে শিশুর প্রাণহানি আর না।

লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক শিশু বার্তা, ই-মেইল : deanmohammadsabbir@gmail.com