দ্বীন মোহাম্মাদ সাব্বির
সম্পাদক –শিশু বার্তা
করোনা পরিস্থিতি সাভাবিক রাখতে বিশ্বব্যাপী লকডাউন চলছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেকেও লকডাউন করে রাখা হচ্ছে। লকডাউনের প্রভাবে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক কর্মসংস্থান। কোথাও কোথাও সিমীত আকারে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা রাখা হয়েছে। কিন্তু এতে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ। করোনা পরিস্থিতি সাভাবিক হলে এ ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সবার পক্ষেই সম্ভব হবে না৷ এর ফলে দেখা দিতে পারে অথনৈতিক দুরাবস্থা বা দারিদ্রতা । দারিদ্র, অশিক্ষা ও অসচেতনতাকে শিশু শ্রম ও বাল্যবিবাহের মূল কারন
দারিদ্রতাকে শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ের একটি বড় কারন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে হয়ত দরীদ্র পরিবারের অবিভাবকরা সন্তানের লেখাপড়া ও ভরনপোষণ এর দায়িত্ব পালন করতে না পেরে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের শিশুশ্রমের দিকে ঠেলে দেবেন। কিংবা কন্যাসন্তানদের ছোট বয়সে বিয়ে দিতে বাধ্য হবেন। এর ফলে পিছিয়ে পড়বে দেশের অসংখ্য শিশু। শিক্ষায় ঝড়েপড়ার হার বেড়ে যাবে। ফুলের মত বেড়ে উঠতে থাকা শিশুদের ভবিষ্যৎ কুঁড়িতেই বিনষ্ট হবার করুন সম্ভাবনা রয়েছে। দেশ অথনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিগতদিনের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার সে ধারা অত্যহত রাখতে খানিকটা বেগ পেতে হতে পারে আমাদের।
করোনা পরিস্থিতির পরবর্তিতে আশংকাজনক হারে বাড়তে পারে শিশু শ্রম ও বাল্যবিবাহ শিশু শ্রম শিশুদের জীবনে বেড়ে ওঠার পথে বড় একটি বাধা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১৫ লাখ শিশুর শিশুশ্রম নিরসন করা সম্ভব হয়েছে। জাতীয় শিশু শ্রম জরিপ-২০১৩’ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সের প্রায় ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু কোনো না কোনো শ্রমে নিয়োজিত। এর মধ্যে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশুই বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত।
শিশু শ্রমের প্রভাবে,ছোট ছোট শিশুদের স্বাস্থহানী, দেশের স্বাক্ষরতার হার হ্রাস, এছাড়াও শিশু শ্রমের সাথে শিশুদের শিক্ষার একটি বিপরীতমুখী অবস্থা সৃষ্টি হয়।এর ফলে আগামী প্রজন্ম অশিক্ষা ও অদক্ষতা নিয়ে বেড়ে উঠবে তাই শিশু শ্রম জাতীয় অর্থনৈতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং শিশু শ্রমের সাথে জড়িত শিশুরা বেশিরভাগ সময়ই নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রতিশোধমূলক মনোভাবের দিকে ধাবিত হয়। তারা অপরাধ প্রবণ মনোভাব নিয়ে গড়ে উঠে। আর এভাবেই শিশু শ্রম সমাজে নানা ধরণের নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।
টেকশই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা- এসডিজি অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যমাত্রা আছে। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে শিশুশ্রম নিরসনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনাকে আরও জোরদার করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে আমরা কোনোভাবেই শিশুদের দেখতে চাই না। আমাদের একটা স্বল্প, মধ্য, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে তাদের কাছে যেতে হবে। তাদের সচেতন করতে হবে। তারা কীভাবে আর্থিক সচ্ছলতা আনতে পারে, সেই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
অপরদিকে বাল্যবিবাহ প্রতিটি কন্যাশিশুকে তার জীবনের একটি অসম্পুর্ন অবস্থানে থমকে দেয় বাল্যবিয়ে প্রতিটি মেয়ের জীবনের জন্য একটি হুমকি। এর ফলে প্রতিটি মেয়ের জীবনে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অনেকক্ষেত্রে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে দেখা যায়।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ কর্তৃক প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিশু বিবাহ একটি প্রথা যা নারীদের ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামাজিক মূল্যবোধ ও অসম অবস্থানকে প্রতিফলিত করে।বাংলাদেশে নারীদের প্রায়ই আর্থিক বোঝা হিসাবে দেখা হয়। দারিদ্র ও অশীক্ষা এক্ষেত্রে নির্ধারণী বিষয়, কিন্তু প্রমাণ বলে যে, সকল পটভূমি ও সামাজিক বিভাজনের মধ্যে বাল্যবিবাহ চর্চা করা হয়। বাংলাদেশে ৫০ শতাংশের অধিক নারী যাদের বয়স এখন ২০ এর মাঝামাঝি তাদের ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হবার আগেই বিয়ে হয়েছে। প্রায় ১৮ শতাংশের বিয়ে হয়েছে যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এ নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে কাজে নেওয়া যাবে না। ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত কাজে নেওয়া যাবে, তবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেওয়া যাবে না। শিশু অধিকার সনদে উল্লেখ আছে ১৮ বছরের আগে মেয়েদের ২১ বছরের আগে ছেলেদের বিয়ে দেওয়া যাবে না কিন্তু, দারিদ্রতা ও কিছু সামাজিক সমস্যার কারনে আইনের জায়গায় নির্দিষ্ট আইন থাকলেও বাস্তব চিত্র আলাদা
বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে রেকর্ড পরিমাণ শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছিল বলে দেখা গেছে। বাংলাদেশ বিগত বছরগুলোতে শিশুশ্রম নিরসনে ভালো কাজ করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১৫ লাখ শিশুর শিশুশ্রম নিরসন করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ বিগত বছরগুলোতে শিশুশ্রম নিরসনে ভালো কাজ করেছে। বাংলাদেশের এমন লাখ লাখ শিশু এখন স্কুলে যায়। এসব শিশুর জীবনমানের উন্নয়ন হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এবং বাল্য বিয়ে বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ২০১৮ সালে ইউনিসেফ কর্তৃক বাংলাদেশ সরকারকে বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করা হয় কিন্তু করোনা পরিস্থিতি সাভাবিক হলে এই সফলতা ধরে রাখা যাবে কিনা এ নিয়ে রয়েছে আশংকা। বিগতদিনের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার সে ধারা অত্যহত রাখতে খানিকটা বেগ পেতে হতে পারে আমাদের।
করোনা পরিস্থিতি সাভাবিক হলে এ ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষেই সম্ভব হবে না৷ আমরা দেখে থাকি বাংলাদেশ সামাজিক নিরাপত্তার জন্য (বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধি ভাতা সহ বিভিন্ন প্রকল্প) বিপুল অর্থ ব্যয় করে। অন্তত দেশের শিশুদের অধিকার অক্ষুন্ন রাখতে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের কথা ভেবে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। তাহলে করোনা পরবর্তীতে সময়ে শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ের সম্ভাব্য বিপর্যয় রেধ কবা সম্ভব হবে টেকশই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জন করতে হলে শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ে নিরসনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনাকে আরও জোরদার করতে হবে। আমরা চাই, সকল শিশু স্কুলে যাক। সবাই তাদের শৈশবকে উপভোগ করুক। শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ের নিরসন করতে হলে সরকারের দিক থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার, বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনা এবং সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :