অটিস্টিক শিশুদের বঞ্চিত না করে, উন্নয়নে অংশীদার করুন


শরিফুল ইসলাম,শেরপুর : প্রকাশের সময় : ৩০/০৮/২০২২, ২:৫৯ PM
অটিস্টিক শিশুদের বঞ্চিত না করে, উন্নয়নে অংশীদার করুন
বেশ কিছুদিন আগে বাবার সাথে এক ব্যাংকে গিয়েছিলাম। ব্যাংকে গিয়ে এমন একটি হৃদয়বিদারক ঘটনার সাক্ষী হবো কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। ছেলেটিকে দেখে মনে হলো বয়স ১২ বছরের আশেপাশেই হবে হয়তো। ছেলেটির মা ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা। ছেলেটি সেদিন তার মায়ের সাথে প্রথম ব্যাংকে এসেছিল। ছেলেটির আচরণ কেমন যেন একটু অন্যরকম ছিল। প্রথমে বুঝতে না পারলেও কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারি ছেলেটি অটিজমে আক্রান্ত। কিছু মানুষ সে বিষয়ে বলাবলি করছিলো। ছেলেটি মোবাইলে খেলছে এবং একটু অস্বস্তি বোধ করছে। ছেলেটির মা ছেলেটিকে বলছিল তন্ময় বাবা এমন করে না ভালো করে গেম খেলো তুমি জিতবে। এরকম নানা ধরনের আশ্বাস দিচ্ছিলো  ব্যাংকের কর্মকর্তা মা। কিছুক্ষণ পর ব্যাংকের ম্যানেজার এসে ছেলেটির মাকে বলতে লাগলো এরকম ছেলেকে ব্যাংকে নিয়ে আসছেন কেন? ছেলেটির মা উত্তরে ম্যানেজার কে বলল স্যার কালকে থেকে আমার ছেলেটা কান্না করছে আমার সাথে ব্যাংকে আসবে। তখন ব্যাংক ম্যানেজার বলল আচ্ছা হয়েছে এখন ছেলেকে বাসায় রেখে আসেন তারপর চাকরিতে জয়েন করবেন। দেখছেন না সকল কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না। ছেলেটির মা বলল আচ্ছা স্যার ঠিক আছে।
আমি কথাগুলো শুনছিলাম এবং দেখতে পেলাম ছেলেটির মায়ের চোখে পানি। ছেলেটির মা যখন ছেলেটিকে নিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন আমি কৌতূলের বশবর্তী হয়ে ছেলেটির মাকে প্রশ্ন করেছিলাম আপনার ছেলে কোন শ্রেণীতে পড়ে? তিনি উত্তরে বলেছিলেন কোন শ্রেণীতে পড়াশোনা করে না। কেন স্কুলে ভর্তি করেননি? উত্তরে তিনি বললেন আমার ছেলেকে কোন স্কুলে ভর্তি করতে চায় না। যেখানে তাকে ভর্তি করাতে গিয়েছি সেখানেই অপমান হতে এবং বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। আমি তাকে নিজেই পড়াই। মানুষ তাকে দেশের বোঝা ভাবতে পারে কিন্তু আমার ছেলে কখনোই আমার কাছে বোঝা নয়। এছাড়াও ছেলেটির মা ছেলেটির বিভিন্ন প্রতিভার কথা বললেন কিন্তু এগুলো বিকশিত করার জন্য কোন সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। কথাগুলো আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেল। না জানি তন্ময়ের মতো কত অটিজম আক্রান্ত শিশুকে এরকম নানা ধরনের বঞ্চনা এবং অপমানের শিকার হতে হচ্ছে। আমি নারী,পুরুষ কিংবা প্রতিবন্ধী যেটা হয় না কেন সকল কিছুর উর্ধ্বে আমি একজন মানুষ। আর এটাই হচ্ছে আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।
মানবাধিকার সূত্রে মানুষ হিসেবে সকলেরই সমান সুযোগ- সুবিধা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এর সাথে শিশুদের জন্য রয়েছে বাড়তি অধিকার যাকে আমরা জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ বলে থাকি। নানা ক্ষেত্রে এইসব অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অটিজম আক্রান্ত শিশুরা। আমাদের দেশের জাতীয় শিশু নীতি ২০১১ তে বলা আছে অটিস্টিক শিশুদের অধিকারের কথা। আমরা যদি সেদিকে একটু আলোকপাত করি তাহলে দেখতে পাই যে, অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষা সহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের অধিকারের কথা সেখানে বলা আছে। তবুও আমাদের দেশে অটিজম আক্রান্ত শিশুরা সে অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেক অটিজম আক্রান্ত শিশুদেরকে সমাজের ভয়ে আড়াল করে চার দেয়ালের মাঝে বন্দী করে রাখছে অভিভাবকেরা। একজন শিশু যদি অটিজম আক্রান্ত হয় এটি কি তার দোষ?অটিজম তো একটি স্নায়ু বিকাশ গত সমস্যা। অটিজমে আক্রান্ত কি আপনি কিংবা আপনার সন্তানও হতে পারতো না? আমরা কি কখনো নিজেদের সেই প্রশ্ন করছি? আমাদের সমাজের কিছু মানুষ রয়েছে যারা অটিজমের আক্রান্ত শিশুদের দেশের বোঝা মনে করে এবং সমালোচনা করতে অনেক ভালোবাসে। মূলত এ কারণেই অটিজম আক্রান্ত শিশুদের অভিভাবকেরা তাদেরকে আড়াল করে রাখে। যত দিন যেতে থাকে অটিজম আক্রান্ত শিশুরা বড় হতে থাকে এবং আস্তে আস্তে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। তারপর আসে শিক্ষা ব্যবস্থা। যদিও সরকারের গৃহীত সকল শিশুর জন্য শিক্ষা আইনটি সব শিশুদের জন্য শিক্ষার সুযোগ এনে দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, অটিজম আক্রান্ত শিশুরা এতে কতটুকু লাভবান হচ্ছে? কিছু শিশুদের বেলায় তো এমনটা ঘটেছে যে কোন স্কুলে তাকে ভর্তি নিচ্ছে না কারণ কোন শিক্ষকই তাকে শিক্ষা দিতে উৎসাহী নন। তাদের ধারণা তারা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবেনা। এছাড়াও আমাদের দেশের শহর অঞ্চলে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জন্য একটি নির্দিষ্ট বিদ্যালয় থাকলেও গ্রাম অঞ্চল কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেই বিদ্যালয়গুলো নেই। যার কারনে গ্রামে অটিজম আক্রান্ত শিশুরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বেশিরভাগ অটিজম আক্রান্ত শিশুর বিশেষ কিছু গুণ থাকে। যেমন:- কেউ অনেক ভালো ছবি আঁকতে পারে, আবার কেউ ভালো গান গাইতে পারে, কেউ গণিতে কিংবা কম্পিউটারে খুবই দক্ষ হয়ে থাকে। কিন্তু সমাজে তাদের এই প্রতিভাগুলো বিকাশের সুযোগ দেওয়া হয় না। ফলে এসব অটিজম আক্রান্ত শিশুদের প্রতিভা থাকলেও তারা তা কাজে লাগাতে পারছে না। এর একটিই কারণ সমাজের মানুষ মনে করে তারা কিছুই পারেন না , তারা দেশের বোঝা। কিন্তু এমন অটিজম আক্রান্ত অনেক ব্যক্তি আছেন যারা অটিজমকে জয় করে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ডেরিল হান্না।
ডেরিল হান্না অটিজম আক্রান্ত ছিলেন। তিনি অটিজমকে জয় করে হলিউডের একজন অভিনেত্রী হয়েছিলেন। অটিজম জয় করার কথাটা তিনি নিজেই বলেছিলেন। তার বাবা-মায়ের সঠিক পরিচর্যা, উৎসাহ ও সুযোগ দেওয়ার ফলে তিনি অটিজমকে জয় করেছেন।
সংবাদ মাধ্যম প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে ১০ হাজার শিশুর মধ্যে ১৫ জন শিশু অটিজমে আক্রান্ত। যেহেতু এটি একটি স্নায়ু বিকাশ গত সমস্যা ভবিষ্যতে এর সংখ্যা আরো অনেক বাড়বে। এদেরকে সমাজের সাথে মানিয়ে নিতে হবে।
আমি মনে করি, অটিজম আক্রান্ত শিশুরা দেশের বোঝা নয় বরং সম্পদ। তাদেরকে সঠিক পরিচর্যা করতে হবে ও উৎসাহ জাগাতে হবে এবং ভালবাসতে হবে। তাদেরকে সকল ক্ষেত্রেই অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। সমাজের সকল মানুষকে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের সাথে মেলামেশা করতে হবে। তাহলে তারা নিজেদের স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করবে এবং তারা দেশের উন্নয়নে অংশীদার হবে।