পর্যাপ্ত বিদ্যালয়ের সংকটে স্কুল বিমুখ পাকিস্তানের ২ কোটি ৬২ লাখ শিশু


Sub Editor প্রকাশের সময় : ০১/০৪/২০২৪, ৭:২১ AM
পর্যাপ্ত বিদ্যালয়ের সংকটে  স্কুল বিমুখ পাকিস্তানের ২ কোটি ৬২ লাখ শিশু

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যখন বোমা এবং অস্ত্র কেনার জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে, তখন দেশটির স্কুল থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ শিশু। বেঁচে থাকার জন্য একটি নিরাপদ জায়গাও যেন অবশিষ্ট নেই তাদের। দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিশ্বের ষষ্ঠ সর্বোচ্চ সশস্ত্র বাহিনীযুক্ত দেশ পাকিস্তানে স্কুল বহির্ভূত শিশুর সংখ্যা ২ কোটি ২০ লাখ থেকে বেড়ে ২ কোটি ৬২ লাখে দাঁড়িয়েছে। দেশটিতে নেই পর্যাপ্ত বিদ্যালয় এবং যেখানে বিদ্যালয় আছে সেখানে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই এবং শিক্ষক থাকলে মৌলিক অবকাঠামো অনুপস্থিত। ফলে প্রতি বছর এই সংখ্যা বাড়ছে।

সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, খাইবার পাখতুনখোয়ায় ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী ৩৭ লাখ শিশু স্কুলে যেতে পারছে না, যা ২০২৮ সালে ছিল ২১ লাখ। একইভাবে পাঞ্জাবের ৭৭ লাখ এবং সিন্ধুতে ৬৪ লাখ শিশু স্কুলে যেতে পারেনি। বালুচিস্তানে ৬৫ শতাংশ শিশু স্কুলের বাইরে রয়েছে।

ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতারা একে অপরকে কাঁদা ছোড়ায় ব্যস্ত। সেনাবাহিনীর সুদৃষ্টিতে থাকতে তাদের প্রচেষ্টাও বেশ চোখে পড়ার মত। কিন্তু চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে দেশটির লক্ষ লক্ষ শিশু, যারা ইট ভাটা ও বাজারে দাস হিসেবে কাজ করে, যৌন শিকারিদের শিকার হয় এবং স্কুলের বাইরে থাকে। এসব শিশুদের নিয়ে রাজনৈতিকদের কোন চিন্তা নেই।

পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অফ এডুকেশনের (পিআইই) ২০২১-২২ সালের শিক্ষা পরিসংখ্যানের রিপোর্ট বলছে, স্কুল বহির্ভূত শিশুদের প্রাদুর্ভাব ভয়ঙ্কর। ২০২১-২২ সাল পর্যন্ত, পাকিস্তান জুড়ে ২ কোটি ৬২ লাখ স্কুল-বহির্ভূত শিশু রয়েছে, যা বড় উদ্বেগের কারণ। উল্লেখযোগ্যভাবে, দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনালের মতে, স্কুলগামী বয়সের ৩৯ শতাংশ শিশু বর্তমানে স্কুলের বাইরে রয়েছে, যা সর্বজনীন শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে মার্কিন শ্রম বিভাগ জানিয়েছে, পাকিস্তানে প্রতি বছর ৩ হাজারেরও বেশি শিশু অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি যৌন নির্যাতন। লক্ষ লক্ষ শিশুকে শ্রমিকদের বাড়ি এবং দোকানে নিযুক্ত করা হয় যেখানে তাদের বাধ্যতামূলক শ্রমের শর্তে কাজ করতে হয়। কর্মক্ষেত্রে তারা যৌন নিপীড়ন এবং চরম শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দরিদ্র পরিবারগুলো ঋণের দায় মেটাতে এইসব শিশুদের বিক্রি করে দেন ইটভাটায় অথবা কলকারখানায় অথবা বাসা বাড়ির কাজে। সেখান থেকে অনেকে শিশু পাচারের শিকার হয়। যাদের অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তি, যৌনতা এবং জোরপূর্বক শ্রমে নিযুক্ত করা হয়।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, পাকিস্তানের ইটভাটায় কর্মরত ৪০ লাখের বেশি মানুষের মধ্যে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ শিশু। যে সময়ে তাদের স্কুলে যাওয়ার কথা; সে সময়ে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে কাস্তে-শাবল। এই বছরের মার্চের গোড়ার দিকে, শিশু অধিকার সংক্রান্ত জাতীয় কমিশন একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র সিন্ধুতেই ৭ লাখের বেশি শিশু ইট ভাটায় শ্রমিক হিসাবে নিযুক্ত রয়েছে। এদের মধ্যে যারা এই শ্রম দাসত্ব থেকে মুক্তি পায় তাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষাবৃত্তি, মাদক পাচার, শিশু পর্নোগ্রাফি এবং যৌনতায় বাধ্য হতে হয়।

পাকিস্তানের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সবচেয়ে চরম ব্যর্থতা হল স্কুলের শিশুদের চরম অবহেলা। দেশটির দুর্বল তরুণ প্রজন্ম বর্ষীয়ান নেতাদের অবহেলার কারণে মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। সরকারের পর সরকার আসলেও কেউই শিশুদের এই নাজুক পরিসংখ্যান থেকে শিক্ষা নিতে পারেনি। শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভগুলির মধ্যে একটির বাজেট বরাদ্দ তার জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ। শিক্ষার ক্রমবর্ধমান শূন্যতা পূরণের জন্য জিডিপির অন্তত চার শতাংশ আলাদা করে রাখা জরুরি। যদিও শিক্ষায় গুরুতর সমস্যা সমাধানের জন্য জাতীয় শিক্ষা নীতি ঘোষণা করেছেন তবে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি এবং সংকল্পের সাথে অনুসরণ করা না হলে এ কর্মপরিকল্পনাটিও ভেস্তে যেতে পারে। এ বিষয়ে সর্বশেষ বাস্তব চিত্রটি মোটেও সুখকর নয়।

তহবিলের অভাবে সরকারী বিদ্যালয়গুলোকে বেসরকারিকরণের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে খোদ সরকারের পক্ষ থেকে। পাঞ্জাবের ১ হাজারের বেশি সরকারী স্কুল বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের কাছে ইজারা দেওয়ার তালিকায় রয়েছে। ওই বিনিয়োগকারীরা কোটি কোটি টাকার মূল্যের ভবন, খেলার মাঠ এবং পরীক্ষাগারসহ সম্পদ দখল করবে। এর সহজ অর্থ এই যে— এই স্কুলগুলি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের নাগালের বাইরে চলে যাবে। ফলাফল পাকিস্তানের অল্পবয়সী ছাত্রদের জন্য আরও বিপর্যয়কর হবে। আরও বেশি শিশু স্কুলের বাইরে থাকতে বাধ্য হবে কারণ তাদের বাবা-মা তাদের শিক্ষার খরচ বহন করতে সক্ষম হবে না। অপরাধ, দাসত্ব এবং হতাশার দুষ্ট চক্র আজ লক্ষ লক্ষ শিশুর দিকে তাকিয়ে আছে।