‘ভাইজান, ফুল নেন.. নেন একটা ফুল ..
ভাবীরে দিয়েন খুশি হইবো..
আফা, ফুল গুলা লইয়া যান
ঘর সাজাইয়েন । খোঁপায় পইরেন।
একটা ফুল দশ টেকা । এই ফুল নেন…. ফুল…
একটা ফুল নেন–দশটা টেকা দেন- ভাত খামু।‘
রাস্তায় গাড়ি থামলেই ছুটে গাড়ির কাছে যায় আর জোরে জোরে এই কথাগুলো বলতে থাকে ছোট্ট একটা মেয়ে।
পরনে ছেঁড়া জামা।
মাথার চুল গুলো এলোমেলো।পায়ে জুতা, স্যান্ডেল নাই। এই শীতের মধ্যে একটা জামা আর খালি পায়ে
ছুটছে ফুল বিক্রি করার জন্য। গাঁয়ের রঙ
ফর্সা হলেও কেমন মলিন দেখাচ্ছে।
ময়লা, মলিন চেহারাটা নিয়ে সে হাসি দিয়ে অভিনেতার মতো অভিনয় করে যাচ্ছে। ঠোঁটে মুখে ক্রিম দেয়া হয়নি।
ফেটে গেছে তাই কিছুটা। হিমেল হাওয়া বইছে।
সূর্যের কিরণ তেমন দেখা যায় না
গাড়ির ভিতরেও ঠান্ডা লাগে। আর এই ছোট্ট মেয়েটা
ঠান্ডা বাতাসে খালি পায়ে দৌড়ে দৌড়ে ফুল বিক্রি করছে!
একটা গাড়ি থামলেই সে ছুটে যায়।
ট্র্যাফিক জ্যামে বসে থাকতে থাকতে ঈরা ও ইফতি দু ভাই বোন অস্থির । ইফতি একটু বড় । ও ক্লাস ফাইভে পড়ে শহরের নামী স্কুলে।
ঈরা অনেক ছোট । গত বছরই সে একটা স্কুলে ভর্তি হলো।
ঈরা কৌতুহল বশত: জানালা খুলতেই মেয়েটা আবার কাছে এসে,
বলছে, ‘বইন একটা ফুল লইয়া যান
এই ফুলের মালাডা নেন। মায়েরে দিয়েন। খুশি হইব।
ঘর সাজাইয়েন। সুন্দর লাগব।”
“তোমার নাম কি? কোথায় থাকো? বাসা কোথায় তোমার
এখন বাইরে আসছো কেন? তুমি ফুল বিক্রি করো কেন? করোনা হবে তো মানুষের ভীড়ে থাকলে!”
ঈরা এক শ্বাসে অনেক গুলো প্রশ্ন করে জানতে চাইলো।
ভিতরে বড় ভাই ইফতি পাশে বসে আছে । ও ঈরার কান্ড দেখে হাসছে। গাড়ির সামনে বসা বাবা বলছিলেন, ‘ঈরা এতো কথা বলো না।জানালা বন্ধ করে দাও।‘
ঈরা নার্সারি ক্লাসে পড়ে । ঈরা অনেক কিছুই সে বুঝে না।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার কয়েক মাস পরেই
হঠাৎ করে স্কুল বন্ধ হলো। প্রথমে সে বুঝতে পারছিলো না কেন স্কুল বন্ধ দিয়ে দিলো।
আর খুলছে না কেন। করোনা নামে কি একটা
রোগ এসেছে বলছিলেন মামণি। অন লাইন ক্লাসে টিচার ও
বলেছেন স্কুলে মানুষের ভীড়ে না আসা ভালো
কিছু নিয়ম মেনে চললে করোনা হয় না।
তাইতো ঘরে থাকছে। অন লাইনে ক্লাস করছে প্রতিদিন।
কিন্তু সে যে আগের মতো খেলতে যেতে পারছে না!
মিশু, মনি, শোভা, দিনা সব বন্ধুদের সাথে গল্প করতে
পারছে না! এজন্য ওর ভীষণ মন খারাপ।
ইফতিও অস্থির হয়ে উঠেছে কবে স্কুল খুলবে
বার বার জিজ্ঞাসা করে বাবা মাকে। পড়বে দৌড় ঝাঁপ করবে । ক্রিকেট খেলবে বন্ধুদের সাথে। কিন্তু স্কুল তো
খোলে না। কোথায় খেলবে ওরা?
অন লাইনে বসে বসে ক্লাস করতে ভালো লাগে?’
বাবা মা দুজনেই বলেন ‘আগে জীবন বাঁচুক তারপর পড়াশোনা কোরো।‘
দিনের পর দিন বাসায় থাকতে ওদের ভালো লাগছিলো না।তাই ওরা নিজেদের এসি গাড়িতে বাবার সাথে
একটু বের হয়েছে ঘুরবে বলে। কিন্তু দুজনেই মুখে মাস্ক
দেয়া আছে। হাত জীবাণু মুক্ত রাখার জন্য গাড়িতে হ্যান্ড
ক্লিনার আছে।
প্রতিদিন টিভিতে দেখে দেখে দুভাইবোন জেনেছে যে
চীন থেকে এই রোগ এসেছে। ছোট্ট জীবাণু এটা।
ধরা ছোঁয়া ও শ্বাসের মাধ্যমে এক জন থেকে অন্যের
শরীরে ঢুকে যায়। এজন্য সাবান দিয়ে বা ক্লিনার দিয়ে হাত মুখ ফেলতে হয় বার বার। নাকে মুখে হাত দিতে হয় না।
হাঁচি কাশি দিলে নাক মুখ ঢেকে রাখতে হয়।
গরম খাবার খেতে হয় ।
কারো বাসায় যাওয়া যায় না। শুধু ঘরে থাকতে হয়।
দরকারি কাজে বাইরে গেলে মুখে মাস্ক দিতে হয়,
মানুষের ভীড় থেকে দূরে থাকতে হয়।‘
‘দেখেছো বাবা, এখানে অনেক মানুষের ভীড় ?’
আচ্ছা, বাবা, তুমি যে বলো ঘর থেকে বাইরে যেও না।
কিন্তু এখানে তো অনেক মানুষ। ওদের করোনা হবে না?
বাবা বললেন হতে পারে। সত্যি এতো অসচেতন কেন
মানুষ গুলো?
এই ঈরা মা, জানালা বন্ধ করে রাখো। ফুল ধরো না । ফুলে করোনা জীবাণু থাকতে পারে ।
ঈরার দেখাদেখি ইফতিও জানালা খুলে দেখছে সব।
সবার মুখে মাস্ক নেই। ঈরা দেখছে সব কিছু।
ফুলওয়ালী মেয়েটা একটু কাছে এসে বলল, “আমার নাম ফিরোজা। বাসা ঐহানে বস্তিতে।
বাসায় থাকলে তো ভালো হইতো কিন্তুক
কিন্তু খামু কি?
ফুল বিক্রি কইরা যেই টেকা পাই হেইডা দিয়াই
মা ভাইডারে লইয়া ভাত খাই।
ঘরে থাকলে খাওন দিবো কে কন?
আমাগো তো বাপ নাই। মায়ের অসুখ। কাম করতে পারে না। তবু মা ফুল ধুইয়া সাজাইয়া দেয় । আমি বিক্রি করি। আমরা গরীব, করোনার ভয় করলে হইবো না।“
এমনিতেই ঈরার মন খারাপ। স্কুলে গিয়ে
প্রথম কয়েক দিন খারাপ লাগলেও পরে ভীষণ ভালো
লেগেছিল দুটো মাস। অনেক বন্ধু হয়েছিল ওর,
কত গল্প করতো। খেলতে যেতো মাঠে। স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছিল!
এখন ছেঁড়া জামা পড়া এই মেয়েটা দেখে ওর খুব
খারাপ লাগছে। ওর কি একটা সুয়েটার ও নেই?
ফিরোজা তো ওর সমান ।তাহলে এত কষ্টের কাজ করছে কেন ?
ঈরা আর ইফতিকে তো বাবা কত জামা কিনে দেয়!
সে বাবাকে বলল বাবা ফিরোজাকে
তুমি একটু টাকা দিয়ে দাও না?
আচ্ছা ঠিক আছে দিবো। তুমি বলেছো না?
মেয়েটার খুশির জন্য বাবা আশিকুর রহমান মানি ব্যাগ থেকে একশ টাকা নিয়ে বললেন,
“ফিরোজা, এদিকে আসো তোমার ফুল লাগবে না।
তুমি এই টাকাটা রাখো।“
“কি কন সাব ফুল না বিক্রি কইরা টেকা নিমু?
মায় কইছে কারো কাছে ভিক্ষা চাইতে না
ফুল না লইলে আমি টেকা নিমু না!
ফুলে করোনা নাই সাব । মায় সুন্দর কইরা ধুইয়া দিছে’।
ঠিক আছে কিছু ফুল তুমি গাড়িতে রেখে যাও।
ফিরোজা ফুল দিয়ে টাকা নিলো
ঈরা অবাক হয়ে জানতে চাইলো, ‘ফিরোজা,
এতো কিছু কেমন করে শিখলে কেমন করে
তোমার মা কি অনেক লেখাপড়া জানে…!’
জ্যাম শেষ হলে গাড়ি আবার চলতে লাগলো।
কিন্তু ইরার ইচ্ছে করছে ফিরোজার সাথে কিছুক্ষণ
ঘুরতে! কথা বলতে!
ও ঠিক করলো বাবাকে বলে সে এখানে আগামীকাল আবার আসতে চায় ।
“বাবা,এই জায়গাটায় আগামীকাল
এখানে আমাকে একটু নিয়ে আসবে, বাবা।“
‘তোমার এই জায়গাটা তোমার ভালো লেগেছে?
‘ঠিক আছে, ‘মামণি, তুমি তৈরি থেকো আমি অফিস থেকে ফিরেই তোমাকে নিয়ে আসবো,”
বললেন বাবা
পরের দিন বাবার সাথে এসে
ফিরোজা কে খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণ পর কোথ্বেকে ফিরোজা কতগুলো ফুল হাতে ছালাম দিল
ঈরা গাড়িতে ব্যাগে করে কয়েকটা জামা প্যান্ট, জুতা
আর সুয়েটার নিয়ে এসেছিল ।সে ব্যাগটা
ফিরোজার হাতে তুলে দিলো।
আর ফিরোজার মলিন মুখটায় হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখা গেলো।জামা কাপড় পেয়ে হাসি দিয়ে বলল
‘আফামণি, তুমি তাইলে এই ফুলগুলা লও।‘
বাবা বললেন, ‘না ফুল লাগবে না।‘
‘কিচ্ছু হইবো না ডরাইয়েন না,
এইগুলান হইল পরিস্কার ফিরোজার ফুল।‘
ঈরা ফুলগুলো খুশি হয়ে নিল
বাসায় এলে মামণি বললেন
‘ফুল কেন?’ ঈরা উত্তর দিলো
এগুলো পরিস্কার তো! মামণি, রেখে দিচ্ছি ফুল দানিতে
ফিরোজার ফুল।
সে ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে ফিরোজার কথা
ভাবতে লাগলো। কিছু জামা কাপড় দিতে পেরে
ঈরার চোখে মুখে খুশির রেখা ফুটে উঠলো।
লেখক: নিলুফার জাহান
অধ্যাপক ইংরেজি বিভাগ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ,ঢাকা
আপনার মতামত লিখুন :