নামতা বিড়ম্বনা


ইসরাত জাহান আশা প্রকাশের সময় : ০৩/০৪/২০২৪, ১২:৫৩ AM
নামতা বিড়ম্বনা

আজ ভোর বেলা থেকেই ব্যাক্কেলপুরের আকাশ কেমন ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন রাতভর অক্লান্ত পরিশ্রম করে আকাশ এই ঘন কালো মেঘগুলি পুঁজি করেছে। তাই তো সকাল থেকেই মেঘপুঞ্জ স্বমহিমায় গুরুম গুরুম করে ডাক ভেঙে আপন অস্তিত্বের জানান দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভারী অদ্ভুত ব্যাপার, এখনো বৃষ্টি নামে নি! ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে।

হাবু তার ক্লাসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আপন মনে আকাশে মেঘের আনাগোনা লক্ষ্য করছে। কি সুন্দর! হেসে খেলে মেঘের ভেলাটা ভেসে বেড়াচ্ছে, আবার খানিক পরপর সূর্যকে ঢেকে দিচ্ছে!

হুট করে কোত্থেকে যেন তীব্র গতিবেগে একটা চকের টুকরা তার দিকে ছুটে এসে চোখের কোনায় ঠিক কপালের ধারটাতে যেই আঘাত করল ওমনি হাবুর চৈতন্য ফিরে এলো, অবাক চোখে মাস্টার মশাইয়ের দিকে চোখ ফিরতেই তার বুকটা কেমন জানি ধক করে উঠল! এদিকে এতো করুণ একটা সময়েও তার ক্লাসের সহপাঠীরা তার দিকে চেয়ে দাঁত বের করে কেমন হা হা হা… হো হো হো শব্দ করে হাঁসছে! দেখে হাবুর প্রায় কান্নাই এসে পড়ল। কোন রকমে দাঁতে দাঁত চেপে চোখের কোণে জমতে চাওয়া অশ্রুকণাকে সে প্রতিহত করতে চাইলো, তবুও কান্নার বাঁধ আর মানছে না।
এমতাবস্থায় পুরো ক্লাসের হাঁসি থামাতে মাস্টারমশাই হঠাৎ ধমকে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে পুরো ক্লাস একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল! এরপর মাস্টারমশাই আবার তার চেয়ারে বসলেন, আরাম করে মুখে দুটো পান গুজলেন। এরপর মুখভর্তি পান চাবাতে চাবাতে সে হাবুর দিকে চেয়ে, উঠে দাড়ালেন। তার চোখ কেমন চকচক করছে! এসব মোটেও ভালো লক্ষণ নয়- হাবু সেটা বুঝতে পারছে। আজ তার খবর আছে!

পুরো ক্লাস এখনো নিশ্চুপ। মাস্টারমশাই হাতে একখানা বাঁশের বেত সমেত হাবুর বেঞ্চের পাশে এসে হাজির হলেন। হাবুর এখন বড্ড ভয় করছে! কেন যে সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে গেল! সেজন্যই এখন তার সাথে এসব হচ্ছে!

মাস্টারমশাই এসেই হাবুকে প্রশ্ন করল, ” জানলার বাইরে ওতো কিরে ব্যাটা, হাবু? হাওয়াই মিডাই নাকি যে তোর চোখ একবারে সরতাছিলই না! কয়বার ডাকছি তোরে? চিল্লায়ে চিল্লায়ে ডাকছি!
মাস্টারমশাইয়ের মুখ থেকে জর্দার প্রকট গন্ধ বের হচ্ছিল। মাস্টারমশাইয়ের ধারণা এই জর্দার যাদুবলেই
এই বুড়ো বয়সেও সে এতো প্রাণবন্ত!
প্রাণবন্ত না ছাই…!
তার দাবি অঙ্কে তার ধার এখনো একটুও কমে নাই! এই বিষয়ে এই গায়ে সে নাকি একেবারে নয়া ছোরার (ছুরি) মতন!
পুরো গ্রামে অঙ্ক মানেই আক্কাস আলী মাস্টারমশাই। সবাই তাকে অনেক সম্মান করে! তবে তার স্বভাব, চরিত্র ও কথা-বার্তার জন্য পিঠ পিছে তার গাল-মন্দকারীরও অভাব নেই!

হাবু এখনো অনেক কিছু ভাবছে। মাস্টারমশাইকে বড্ড ভয় পায় হাবু। এই ভয় মোটেও মাস্টারমশাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধাবল থেকে সৃষ্ট নয় বরং যেকোন সময়ে নিজে আহত হবার শঙ্কা! ঠিক এই মুহুর্তেও ভয়ের চোটে তার মুখ দিয়ে একখানা বুলিও বের হচ্ছে না। এই বুঝি এখনই দু- চারটা কষিয়ে লাগিয়ে তাকে অজ্ঞান করে ফেলে!

হাবুর চুপ করে থাকা দেখে মাস্টারমশাই আরো চটে গেলেন। তিনি হাবুকে প্রশ্ন করলেন, ”বলতো, তোর ভাই সাবুকে একটু আগে আমি কোন পড়া ধরছিলাম?”
হাবু একবার সাবুর দিকে চাইলো! পরে বললো,” নামতা, মাস্টারমশাই।”

মাস্টারমশাই আড়চোখে একবার চেয়ে বললেন- কতো ঘরের নামতা?”
হাবু একেবারে নিস্প্রভ হয়ে বললো, ” সাতের ঘরের নামতা।” পুরো ক্লাসের সবাই হেসে দিল। তার জবাব শেষে অনেক ছেলে মেয়ে ফিসফাস করছিল নয় এর ঘরের নামতা! সে আর এখন শুনে কি লাভ?

আক্কাস আলীর চোখ আবার চকচক করে উঠল, ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা, সে হয়তো ব্যাপক পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে!
আক্কাস আলী বললেন- ” তাই? ঠিক আছে নামতাডা ক দেহি?”

হাবু ছলছল চোখে বলতে আরম্ভ করলো, এই বুঝি সে কেঁদে ফেলবে-
” সাত, একে সাত
সাত, দু’গুনে চইদ্দো
তিন, সাতে এ্যাঁ.. এ্যাঁ..চব্বিশ
(ক্লাসের সবাই আবার হা হা.. হো হো.. করে হেসে উঠল আর হাবু একবার বিব্রত হয়ে সেদিকে চাইলো)। ”

আক্কাস আলী আবার হুংকার দিয়ে উঠলেন, পুরো ক্লাসের সবাই চুপ হয়ে গেল। হাবুর চোখে আত্মসমর্পণের ভাষা ফুটে উঠলেও সে আজ আর তাকে ছাড়বে না, সেজন্য আবার বললো -” তার পরেরটুকুনও ক?”

হাবু একেবারে নিভে গেল! আর বলতে শুরু করল-
” চার, সাতে আটত্রিশ
পাঁচ, সাতে এ্যাঁ.. এ্যাঁ.. পঁয়তাল্লিশ!”

আক্কাস আলী ধমকে উঠলেন,” ব্যাস, অনেক নাটক হইছে, একমাস ধইরা নামতা শিখাইতেছি, এখন বুঝলাম নামতা বাদ দিয়া পুলাপান নাটক করা শিখতাছে! তোর ভাই সাবু তোর থেইকা মেলা ভালা। কি সুন্দর! নামতা একেবারে পানির লাহান টলটল কইরা কইতে পারে”

হাবু দুম করে বলে উঠল- ” নামতা, আমার মুখস্থ হয় না; মাস্টারমশাই।”আর ওমনি ধপাস… ধপাস! ষাটোর্ধ্ব বুড়ো মাস্টারমশাই তার আধ ভাঙা হাত দিয়ে হাবুর পিঠে তিন চারটা কিল-থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বললেন- এত্তোবড় সাহস তোর! আবার মুখে মুখে তর্ক? বাইরে না তাকায়ে আছিলি? যা ওহনই বাইরে গিয়া রইদের মধ্যে কান ধইরা মুরগি হইয়্যা বইসা থাকবি, আমার ক্লাসের ঘন্টা না পড়া অবধি আসবি না, দূর হ, বজ্জাত!”
হাবু মন খারাপ করে তবু কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে ক্লাসে দাঁড়িয়ে রইলো! তার সহপাঠীরা অনেকেই এখনো মিটিমিটি হাসছে।

বাইরের আকাশে মেঘ কেটে গেছে, দেখা দিয়েছে রোদ্দুর। হয়তো হাবুর মনের আকাশটাকে এখন দখলে এনেছে একটু আগে জানালা দিয়ে চেঁয়ে দেখা কালো মেঘগুলো। মাস্টারমশাই আবার হাবুর দিকে চাইলেন আর হুংকার দিয়ে বললেন- ” কিরে, তুই তো অনেক বেদ্দোপরে, মুখে মুখে তর্ক করস, গুরুজনের আদেশও মানস না! এক্ষুনি বের হয়ে যা আমার দুই চোখের সীমানা থেইকা, আর যা বলছি তা কর! নইলে কিন্তু এখন তোরে লাঠি পেটা করমু!
আর হ্যাঁ, এহন থেইকা প্রতিদিন তুই আমারে নামতা পড়া দিবি। যহন যেই ঘরের নামতা মন চাইব, আমি সেই ঘরের নামতাই ধরমু! আর না পারলে তোর খবর আছে!”

এসব শুনে হাবু আরো আতঙ্কিত হয়ে উঠল! নামতা তো তার মনে থাকে না। অঙ্ক করতে কেন জানি তার ভালোই লাগে না! কেউ কেন তা বুঝতে চায় না কে জানে? কি হবে এই নীরস অঙ্ক পড়ে? এর উত্তর হাবুর জানা নেই। হয়তো সে ছাড়া বাকি সবার অঙ্ক অনেক ভালো লাগে! সে জন্যই হয়তো অঙ্ক এখনো এই ময়দানে টিকে আছে!এসব ভাবতে ভাবতে হেঁটে হাবু আনন্দ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে পৌঁছে গেল আর ভীষণ নিরানন্দে কান ধরে মুরগি হয়ে বসে রইল।

লেখক: ইসরাত জাহান (আশা)
বিভাগ: ফুড টেকনোলজি এন্ড নিউট্রিশনাল সায়েন্স
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল