– বাবলু, অ্যাই….. বাবলু, ওঠেকরে লাট সাহেবের ব্যাটা! আর কত ঘুমাবি? খালি খানা আর ঘুম, কামচোর কোনহানকার! আরেকটু বেলা হইলেই খদ্দেররা আইসা দোকানে ভীড় জমাইবো, সব কামই পইড়া রইছে।
বাবলু চোখ খুলে তাঁকাতে পারছে না, তবু কদু মিয়ার ডাক শুনে সে তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ল! হাত মুখ না ধুঁয়ে আগে গেল চুলায় গরম পানির পাতিল আর কেটলি বসাতে। এরপর চায়ের কাপ, গেলাসও তাকে ধুঁতে হবে।
কদু মিয়া বেজায় খিটখিটে মেজাজের লোক। সারাদিনই সে বাবলুর কাজের ভুল ধরতে ব্যস্ত থাকে! মাঝে মাঝে চেঁচামেচি আর মন চাইলে তো গায়ে হাত তুলতেও সে দু’বার ভাবে না!
ওইতো ওইদিনের কথা, খদ্দেরদের চা দিতে গিয়ে রাস্তার ধারের ইটে হঠাৎ সে হোঁচট খেয়ে পড়ল আর ওমনি হাতে থাকা পাঁচখানা চায়ের গেলাসের সবগুলো ভেঙে একেবারে খানখান হয়ে গেল!
বাবলু নিজেকে সামলে নেওয়ার আগেই কদু মিয়া দোকান থেকে উঠে দৌঁড়ে এসে বাবলুর গালে দুই, চারটা থাপ্পড় বসিয়ে বকাবকি আরম্ভ করে দিল-
– হারামজাদা, আমার ব্যবসাডা লাটে উঠাইয়াই তুই ছাড়বি, এগুলার টাহা এহন ক্যাডায় দিব? তোর বাপ?আজকা তোর সব খানাপিনা বন্ধ।
আট বছর বয়সী বাবলু ভয় পেয়ে ওইদিন কেঁদেই ফেলেছিল। ওইদিন কদু মিয়া সারাদিন বাবলুকে কোন কিছুই খেতে দেয়নি। রাতের বেলা শুধু একখানা শুকনো রুটিই জুটেছিল ওইদিন বাবলুর পাতে। অথচ তার সামনেই কদু মিয়ার ছেলে মেয়েরা কি সুন্দর নরম মাংস আর গরম ভাত মাখিয়ে খেয়ে উঠে পড়ল, সেটা বাবলুর বেশ ভালো মনে আছে!
সবকিছু ধুঁয়ে মুছে, দোকানের উঠান সে কোনমতে ঝাঁট দিল। দোকানের বোয়েম গুলোতে জমো হওয়া ধূলো সে নিজের গলাতে সারাদিন ঝুলে থাকা গামছাটা দিয়ে মুছে পরিষ্কার করল। হাত মুখ ধোওয়ার অবকাশ সে পায়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই কদু মিয়া এসে হুকুমজারি করল,
– বাজার থেইকা ওহনি গরুর দুধ নিয়া আয়গা, সাথে চিনি আর চা পাতিও আনবি। সবুর মিয়ারে কইবি বিকাল বেলা আমি গিয়া সব হিসাব চুকায়ে আসব।
বাবলু বেশি কথা বলে না, হয়তো সে বুঝতে পারে যে এইখানে তার কথা নিতান্ত মূল্যহীন। তাইতো কদু মিয়ার আদেশ শোনামাত্র সে সঙ্গে সঙ্গে স্থান ত্যাগ করল।
এতো সকাল বেলাতেও হাট বাজার মানুষে একেবারে গিজগিজ করছে! বাবলু সবুর মিয়ার দোকানে গিয়ে দেখলো অনেক মানুষ, সে একবার সবুর মিয়াকে বললো,
– কাকা, কদু কাকা এহনই দুধ, চিনি আর চা পাতা দিতে কইছে।
সবুর মিয়া, শুনেও যেন শুনল না! সক্কাল সক্কাল ব্যবসায় নেমে বাকিতে সদাই করতে আসা খদ্দেরদের দেখলেই ওর বড্ড রাগ হয়!
বাবলু দাঁড়িয়েই রইলো, কিছুক্ষণ পর একজন বৃদ্ধ ভালো মানুষ সবুর মিয়াকে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলেন,
– সবুর, তোমার কাজ এতো ঢিল গতির কেন? আর এই বাচ্চা মানুষটা কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে, ওর কি চাই, তা ওকে আগে দিয়ে বিদায় করো তো!
সবুর মিয়া একটা বোকা হাসি হেসে বাবলুকে সব দিয়ে দিল। বাবলু বৃদ্ধ লোকটার বকে দেওয়ার ধরণ দেখে মনে মনে বড্ড খুশি হলো।
ফেরার পথে বাবলু মাছের দোকানে লাফালাফি করা পাঙ্গাস মাছ দেখে থেমে গেল। সে দেখতে শুরু করল, কিভাবে মাছগুলো তাদের লেজ আর পাখনা নাড়িয়ে লাফালাফি করছে, এদিক ওদিক পানি ছেটাচ্ছে! তার মুখে একটা মৃদু হাসি ফুটে উঠল। মন চাইলো এদের সাথে একটু খেলা করতে! খানিক পরেই আবার তার মন চাইলো একখানা মাছ কিনে ফেলতে। কতদিন হলো সে মাছের ঝোল দিয়ে গরম গরম ভাত খায় না!
বাবলুর মনে পড়ে গেল, মা বেঁচে থাকতে তাদের পুকুরের পাঙ্গাস ধরে, ক্ষেতের গুটিকয়েক আলু আর টমেটো তুলে কি সুন্দর মাছের ঝোল করত।
নিজের অজান্তেই বাবলুর নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠতে শুরু করল! হুঠ করেই দোকানদার চেঁচিয়ে তাকে দোকানের ধার থেকে সরিয়ে দিল। একটু দূরে সরে কি ভেবে দুধ, চিনি সমেত আবার সে দোকানের দিকে হাঁটা শুরু করল।
লেখক: ইসরাত জাহান (আশা)
বিভাগ: ফুড টেকনোলজি এন্ড নিউট্রিশনাল সায়েন্স
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল
আপনার মতামত লিখুন :