মাহিব রেজা, ঢাকা:
গম্ভীর আওয়াজ তুলে বিশালাকার জাহাজ সেন্ট মার্টিনের তীরে এসে নোঙর করল। আনন্দে রাশিকের মন লাফ দিয়ে উঠল। শেষমেশ সেন্ট মার্টিনে পৌঁছানো গেল। ইশ! কত দিন ধরে এই সময়টার অপেক্ষা করেছে রাশিক। সেটা যে আজকে সত্যি সত্যি এসে গেছে, সেটা বিশ্বাসই হতে চায় না। আরো কিছুক্ষণ বসে থাকতে হবে। কেবিনের জানালা দিয়ে সেন্ট মার্টিন দেখা যাচ্ছে। নীল পানির ঢেউয়ে এক টুকরা দ্বীপ। চারপাশে সাদা বালি দূর থেকেও চিকচিক করে ওঠে। মনে হয় এখুনি চলে যাওয়া গেলে ভালো হত, কিন্তু ছোট বোটে করে যেতে হবে।
কিছুক্ষণ পর রাশিক বোটে উঠল। তারপর আরো কিছুদূর সাগরের পানিতে ভেসে শেষমেশ পৌঁছালো সেন্ট মার্টিনে। ‘ইশ! কি সুন্দর চারপাশটা।‘ রাশিক অবাক হয়ে যায়। লম্বা সারি সারি কেয়া আর ঝাউ। চারদিকে নীল আর সবুজের ছড়াছড়ি।
রাশিক এবার ক্লাস সেভেনে। সেন্ট মার্টিনে এই প্রথমবার এসেছে।
সেন্ট মার্টিনের আগের নাম ছিল -‘নারকেল জিঞ্জিরা’।
এই বড় বড় সারিবদ্ধ নারকেলগাছ গুলো নামের মাহাত্ম্য প্রকাশ করছে।
বাবা বললেন, “বুঝলে রাশিক, সেন্ট মার্টিন হলো আমাদের জাতীয় সম্পদ। পর্যটনকেন্দ্র। অনেকে একে প্রবাল দ্বীপ বলতে চান।“
রাশিক প্রশ্ন করে, “বাবা, প্রবাল দ্বীপ মানে কি?”
বাবা বলেন, “প্রবাল হচ্ছে একপ্রকার প্রাণি। খুবই সরল প্রকৃতির। এদের গায়ে অনেক ছিদ্র আছে। দেখলে মনে হবে যেন এক একেকটা উদ্ভিদ । এদের শরীর বেশ শক্তপোক্ত। যে দ্বীপ এই প্রবাল জমে জমে তৈরি হয়, তাকে প্রবাল দ্বীপ বলে। এই যে দেখছ, কত্ত প্রবাল দেখা যাচ্ছে। এখানে প্রবাল বেশ ভালো জন্মে।
রাশিক অবাক হয়ে যায়। একটা দ্বীপের এতো গল্প?
রাশিকরা একটু এগিয়ে গেলো। সামনে এগুতেই ওরা হরেক রকমের গাছ দেখল, এদের অনেকগুলো তো এরা প্রথমবার দেখছে।
স্থানীয় পর্যটন মোটেলের একজন গাইড রাশিকদের সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাতে লাগল। রাশিক আরো জানতে পারল যে, প্রবালরা খুব মজার প্রাণি।অন্য সবার মতো এরা হাঁটাচলা করে না, অন্যদের মতো এরা খাবারও খায় না। এদের গায়ে যে শৈবাল জন্মে, তার বানানো খাবারে এরা ভাগ বসায়। এই প্রবালদের বন্ধু হলো কচ্ছপরা। প্রবালের গায়ের শৈবাল যাতে পানির ভেতরও পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পায়, সেজন্য কচ্ছপরা আশেপাশের পানি পরিষ্কার রাখে। আবার প্রবালের এই শৈবাল খেতে যেসব ছোট ছোট মাছ আসে, সেগুলো আবার কচ্ছপের সুস্বাদু খাবার।বেশ মজার ব্যাপার, না? ওরাও তাহলে আমাদের মতো বন্ধুর সাথে টিফিন শেয়ার করে!
রাশিক বেশ মজা পায়। ওরা যায় ছোটোমোটো মার্কেটে। দেখে কত্ত রকমের জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে। সে দেখে সমুদ্রের প্রবাল বিক্রি হচ্ছে, কচ্ছপের খোলস বিক্রি হচ্ছে। ছোটবোন অদিতি এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার সে প্রশ্ন করে-‘আচ্ছা ভাইয়া, ওরা যে সাগর থেকে প্রবাল আর কচ্ছপ তুলে এনেছে, এগুলো শেষ হয়ে গেলে?’
“সত্যি তো!” রাশিকের মনে এ কথাটা একবারো আসেনি। কচ্ছপ তো প্রবালের বন্ধু। বন্ধু মরে গেলে অন্য বন্ধুও মরে যাবে। রাশিক কিছুই কিনল না। কেন জানি মনে হলো, এগুলো না কিনলে হয়ত ওরা বেঁচে থাকবে।
কিছুক্ষণ পর রাশিক দেখল, অনেক মানুষ সাগরে পানির বোতল ফেলছে, চিপসের প্যাকেট ফেলছে।
হঠাৎ এক ঝাঁক পাখি রাশিকের চোখ কেড়ে নেয়। ডানা মেলে উড়ে এসে বসে কালো-সাদা প্রবালগুলোতে। হাত-পা নাড়িয়ে সে কি আনন্দ! ঝিরঝির করে বয়ে চলা চঞ্চল বাতাস রাশিকের চুলগুলো নাড়িয়ে দেয়। অদ্ভুত লাগে রাশিকের। আমাদের ‘সেন্ট মার্টিন’ এতো সুন্দর। আরেকটু উত্তরে যেতেই, হঠাৎ যেন একটা কচ্ছপ কথা বলে উঠল। খুবই আস্তে আস্তে, প্রায় শোনাই যায় না। রাশিক আরো এগিয়ে গেল। রাশিকের পায়ে এখন সাগরের ঢেউ এসে ধাক্কা দিচ্ছে। রাশিক আরেকটু ভালোভাবে কান পাতলো। হালকা স্বরে শোনা গেল-“আমাদের বাঁচতে দাও,প্লিজ।“
রাশিক ভাবল, মনের ভ্রম। কিন্তু খানিকবাদেই একটা বালিহাঁস বলল,”আমাদের বাঁচতে দাও”। সাথে সাথে লাল কাঁকড়া, গলদা চিংড়ি, নীল জলের গভীরের মিষ্টি হাঙর,সবুজ সমুদ্রশসা, সোনালি জেলিফিস—সবাই যেন একসাথে বলে উঠল-“আমাদের বাঁচতে দাও,প্লিজ!”
কখন যে বিকেলের সোনালি রোদ সাগরের নীলে ডুব মারল বুঝতেই পারেনি রাশিক। আবছা অন্ধকারে এক দোকানদার এক বস্তা পানির খালি বোতল সাগরের বুকে ছুঁড়ে মারল। মনে হলো, পুরো সাগরটাই বলছে,”আমাদের বাঁচতে দাও।“
বাড়ি ফিরে রাশিক যে খুব চিন্তিত হলো না, তা নয়।অদ্ভুত দ্বীপকে বাঁচতে দিতে চায় রাশিক। তাই প্ল্যান করল। খুব বেশি নয়, বছরে অন্তত দুই জন মানুষ কে সে শপথ করাবে যে তারা যেন সেন্ট মার্টিনে কোন আবর্জনা ফেলে আসবে না। এভাবে দুই জন করতে করতে হয়ত একসময় পুরো দেশের মানুষ ভালো রাখবে সেন্ট মার্টিনকে।
কচ্ছপগুলো দূর থেকে সবটা বুঝতে পারে।ওরা হাসে। মনে মনে ভাবে, “যাক বাবা! এবার মন খুলে বাঁচতে পারব।“
|
আপনার মতামত লিখুন :