নির্বাক পৃথিবী


Admin প্রকাশের সময় : ০৬/০৩/২০২০, ৪:১৪ PM
নির্বাক পৃথিবী

মাহমুদুল বারী হাসান, বরিশাল:
আমি সাজিদ। বরিশাল জেলা শহরে বাস। লেখাপড়া বরিশাল জিলা স্কুল থেকেই। প্রথম থেকেই লেখাপড়ার প্রতি ঝোক থাকায় পৃথিবির অন্যান্য জিনিস থেকে অনেকটা দূরেই থাকা হোতো স্বভাবতই। পারিবারিক কিছু সমস্যার কারনে ভাল ছাত্র হওয়ার পরেও ‘এ+‘ টা মিস হয়ে গেল।তখন সারা দেশ এ ‘এ+‘ এর ছড়াছড়ি। তাই ভাল কলেজ এ ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও পারলামনা।পরে বরিশাল সরকারি কলেজ এ ভর্তি হলাম। প্রথম দিন কলেজ এ কেমন একটা একা একা লাগছিল। আমার স্কুল এ ৯৮% ‘এ+‘  পাওয়ার কারন এ সবাই অন্যান্য কলেজ এ ভর্তি হয়েছিল।ছোটো থেকেই একটু একা একা থাকাই পছন্দ ছিল।তাই কলেজ এ প্রথম দিন এক কোনে একাই বসলাম। ২-৩ দিন কারো সাথে বন্ধুত্তই করতে পারলামনা।কিন্তু অন্য সবাই ঠিকই অনেক বন্ধু করে নিল।সব থেকে বেশি যে বিষয়টা ছিল একটা ছেলে। নাম হাসান।সে এই ২-৩ দিন এ প্রায় ছেলে,মেয়ে সবার সাথেই অনেক ভালো করেই মিশে গেল।ছেলেটা একটু চঞ্চল প্রকৃতির।আমার সাথেও মেশার চেষ্টা করেছিল কিন্তু আমি কেন যানিনা কারো সাথেই মিশতে পারছিলামনা।পরে একটা বন্ধু হল।
ছেলেটা মফস্বল শহর থেকে এসেছিল। এই শহর এর সব কিছুই ওর নতুন। সেও কিছুদিন পর এই নতুন এর মোহে পরে অসৎ সঙ্গ পেয়ে গিয়ে ধুমপান শুরু করল এবং মেয়েদের সঙ্গে পরল।যেগুলো আমার কেন জানিনা মন বিরোধি ছিল সব সময়ই।তাই ওর সাথেও দুরত্ব বাড়ল। তাই কিছু উপায় না পেয়ে সেই বন্ধুবিহীন নিসঙ্গ বই এর উপর মুখ গুজে থাকা জীবন আবার আমার সঙ্গী হল।কলেজ এ ঠিক মত ক্লাস করতাম।মনে হয় ৩-৪ জন নিয়মিত ক্লাস করতাম।কখনো একাও ক্লাস করতাম।
তবে প্রতিদিন ই সেই হাসান নাম এর ছেলেটাকে দেখতাম। হয় সে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে, নয় সে বিনোদন রুম এ কেরাম খেলছে,আবার বিকাল এ যখন প্রাইভেট পরে বাসায় আসতাম তখন দেখতাম মাঠে বসে ক্রিকেট খেলছে।আমাকে যেখানেই দেখতো চাস্মিস বলে ডাক দিত।আমি চশমা পরতাম তবে কেউ আমার চশমা নিয়ে কিছু বললে সে আমার চোখের বিষ হয়ে যেত। কলেজ এ আর কেউ না আসলেও হাসানকে প্রতিদিন ই দেখা যেত। আমি থাকতাম বই নিয়ে একা একা আর হাসান থাকতো তমাল তলায় আড্ডা নিয়ে ব্যস্ত। এভাবেই ১ম বর্ষের ৩টি মাস কেটে যায়।
টিউটোরিয়াল পরিক্ষা এসে পরে। আমার প্রস্তুতি বেশ ভাল এবং পরিক্ষাও ভালই হল।যখন ফলাফল বের হল তখন দেখলাম হাসান ১ম আর আমি ২য়।আমি তো দেখে মনে করেছিলাম হয়ত ভুল আসছে ফলাফল। কারন যে ছেলে একদিন ও ক্লাস করেনা সে কিভাবে ১ম হয়।তার কিছু দিন পরের কথা, হাসান এর একটা ডি-এস-এল-আর ক্যামেরা ছিল। প্রায়ই দেখতাম ও সেইটা নিয়ে বন্ধুদের সাথে অনেক ছবি তুলত।একদিন আমাকে বলল,” তোমার না একটা গিটার আছে? ওইটা নিয়ে একদিন পার্ক এ এসো, আমার গিটার নিয়ে ছবি তোলার অনেক সখ”।আমি পরের দিন কি ভেবে গিটার নিয়ে পার্ক এ আসলাম।ওর সাথে আরও ছেলেরা ছিল। অনেক ছবি তুল্লাম, মজা করলাম।এমন সময় ও যে আমার জীবন এ আসবে সেটা ভাবতেও পারিনি।পরে হাসান এর জোরাজুরির পরে গিটার বাজিয়ে একটা গান গাইলাম। গান আর গিটার মূলত বাবার কাছ থেকেই শিখেছিলাম।অনেক দিন পর আবার গান গাইলাম।
হাসান ছেলেটা আসলেই জাদু জানে কেমন জানি এই অল্প সময় ও আমার অনেক কাছের মানুষ হয়ে গেল। বাবা মারা যাওয়ার পর গিটার বা গান কোনোটাই আর করতামনা।ওর সাথে থাকার পর কেমন জানি মনটা খুব হাল্কা হয়ে গেল।আমার বাবার পর কোনো মানুষ এর সাথে থেকে এতটা মজা করলাম অনেক দিন পর।এর পর কেমন জানি বিকেল হলেই হাসান আর দুইটা বন্ধু আমরা মোট চার জন বিকেলবেলা পার্ক এ আড্ডা দেয়া একটা নেশার মত হয়ে গিয়েছিল।আমি মূলত হাসান এর জন্যই বেশি আসতাম।ও আসলেই একটা পাগল ছেলে।আমার মন ভাল করে দেয়ার বন্ধুও বলা যেতে পারে।আমি কেমন জানি ওর সাথেই থাকাটা পছন্দ করতাম।যে আমার একটা বন্ধুও ছিলনা তখন অনেক বন্ধু আমার। হাসানও আমাকে ছাড়া কিছুই করতনা।
ওর শুধু একটাই আবদার ছিল আমার গলায় প্রতিদিন একটা গান শোনা।আমাকে বলত যেন ও মরার দিনও ওকে একটা গান শুনাই।ও আসলেই একটা পাগল।সারাদিন পাগলামি কিছু না কিছু করতোই।বার্গার খাওয়ার পাল্লা দিতাম আবার ও না পেরে বমি করে দিত। একদিন বিকেলে আমরা চারজন আড্ডা দিচ্ছি তখন বলতেছে তুই যদি আজকে দুটা গান শুনাস তাহলে যে যত ঝাল- মুরি খেতে চায় খাওয়াবো। মজা করেই দুটা গান শুনালাম।ও যে আমার গান এ কি মজা পায় ওই জানে।তারপরে মুড়ি খেতে খেতে বল্ল চল মুড়ি খাওয়ার পাল্লা দেই। চারজন মিলে পাল্লা দিলাম একটু পরে পাগলটায় মুড়ি খেতে খেতে মাথা ঘুরে পরে গেল।ওকে আমার একটা গান শুনিয়ে সব কিছু করাতে পারতাম।এভাবে আমার বই এর উপর মুখ গুজে বসে থাকা জীবনটা হাসান পাগলটায় মজা,হাসি,খুসি,বন্ধু সব কিছু দিয়ে ভরিয়ে দিল।
এভাবে অনেক দিন কেটে গেল। আমরাও এভাবেই মজা করতে করতে অর্ধ বার্ষিক শেষ করলাম।এবার আমি প্রথম আর হাসান দ্বিতীয় হয়েছে।পরে মনে পরল আমি একদিন পাগলটাকে বলেছিলাম আমি যদি পরিক্ষায় ১ম হই তাহলে তোকে একসাথে ২টা গান শুনাব। এভাবেই কাটতে লাগল আমাদের দিনগুলো।
এরপরে হঠাৎ ২-৩ দিন ওর কোনো খবর নেই।আমি কেমন জানি পাগল হয়ে গেলাম।ওকে ছাড়া আমার এক মূহুর্তও চলেনা।ওর ফোনও অফ।ভাবতে ভাবতেই অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসল। রিসিভ করার পর বুঝলাম আন্টি (হাসানের মা)।আমাকে সিটি হাসপাতাল এ আসতে বলল। যখন হাসপাতাল এ গেলাম দেখলাম হাসান আই-সি-ও তে। আন্টি তখন বলা শুরু করল, ” ছয় মাস আগে হাসান যখন অসুস্থ হয়ে পরে অনেক চেকআপ এর পরে ডাক্তার বললেন যে হাসান এর কিডনি একটি পুরো নষ্ট হয়ে গেছে অন্যটি অল্প ভাল আছে আর ক্লোন এ ইনফেকসন হয়েছে। অপারেশন করাও সম্ভব না এবং আরও বলল ও আর ৬ মাস বাচবে। হাসান সব ই জানত। এর আগে ও প্রায়শই ই তোমার গানের কথা বলত,তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইত। তাই ওকে তোমার কলেজ এ ভর্তি করিয়ে দেই। ও তোমার সাথে কথা বলার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। পরে পেরেছে। গত পরশু দিন ও আবার অনেক অসুস্থ হয়ে পরে। ডাক্তার বলছে ওর নাকি শেষ পর্যায়”। এই বলে আন্টি জোড়ে কান্না শুরু করে দিল।
আমি নির্বাক হয়ে শুধু হাসান এর দিকে চেয়ে থাকলাম।এর মধ্যেই হাসান এর হুস ফিরল। ওর কাছে যাওয়া মাত্রই ফিসফিস করে বলল, “কিরে আজ একটা গান শুনাবিনা”। আমি কান্না কন্ঠে একটা গান গাইলাম “বন্ধু আছি একসাথে…….”। আমি গান শেষ করলাম দেখলাম হাসান এর আর নিশ্বাস পড়ছেনা। ডাক্তার এসে বলল “হি ইস নো মোর”। আমার বুক ফেটে কান্না আসছিল, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছিল কিন্তু কি ব্যাপার আমার মুখ থেকে একটাও আওয়াজ বের হলোনা। হাসানও চলে গেল আর সাথে আমার কথাও। আমি এখন “ঢাকা নাক,কান,গলা হাসপাতাল” এ আছি। আমার কলম ঠিকই চলে কিন্তু আমার গান শোনার জন্য আর হাসান বলেনা দোস্ত একটা গান শুনা। তাই হয়তো আজ আমি নির্বাক।।