রোবানুভূতি


Admin প্রকাশের সময় : ০৩/০৩/২০২০, ৭:০৪ PM
রোবানুভূতি

মাহীব রেজা, ঢাকা:

(১) 
রাশিকদের শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা বিশাল হলরুমে বসে ভ্রুতে হাত বোলাচ্ছেন শহরের বিজ্ঞান কাউন্সিলের তরুণ বিজ্ঞানী নূহান। তাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। তার সামনে উত্তেজক পানীয় রাখা। কিন্তু তিনি চুমুক দিচ্ছেন না। গভীর মনোযোগ দিয়ে পানীয়টার দিকে তাকিয়ে আছেন। একটু পর পর তিনি দাঁত খিঁচিয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছেন আর স্ক্রিনে কি এক সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করছেন। খানিক দূরে চকচকে ঝকঝকে কোবাল্ট গ্লাসের উপর আলো ফেলে নীলাভ একটা আলোপ্রভা বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সেখান থেকে আলো এসে পরিবেশটাকে কেমন নীলচে করে দিয়েছে। এতে পানীয়টার রঙটা হয়েছে অদ্ভুত রকমের। এজন্য একবার তিনি আলোটার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হলেন।
তার বিরক্তি ধরা পড়ল ঘরের কোনে দাঁড়ানো একটা বুদ্ধিমান রোবটের সেন্সরে। ব্যস, প্রায় সাথে সাথে একটা ট্রে তে করে ‘ডেকাহেক্সিনোফ্লাইওজ’ গোছের একটা বেশ শক্তিশালী মন ভালো করার বিস্কুট এনে টেবিলে রাখল সে।
-মহামান্য নূহান, আপনার জন্য এই ডিএইচ বিস্কুট। এটা আগেকার-দিনের মানুষদের ‘ফ্লুপেনটাক্সল’ আর ‘মেলিট্রাসেন’র দেখাদেখি বানানো হয়েছে। বেশ কার্যকরী।
-আমি কি এটা আনতে বলেছি? নিজে থেকে এসব করো কেনো? বুদ্ধিমত্তা কি ১ এর নিচে নামিয়ে দেব?
-মহামান্য নূহান, আমি কিন্তু আপনার বিরক্তি কমানোর জন্যই…………
নূহানের মনে হচ্ছে যে এক্ষুনি বুঝি উনি রোবটটার মাথায় কষে একটা ঘুষি মেরে দেবেন।কিন্তু বিজ্ঞান কাউন্সিলের নিয়ম ভাঙতে মন চাইল না নূহানের। নূহান ভাবে, রোবটগুলো দিন দিন দরকারের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান হয়ে উঠছে।
এমন সময় হলরুমের দরজা খুলে ঢিলেঢালা এপ্রোন পরা একজনকে দেখা গেলো। ইনি বিজ্ঞানী হারুতাসি। নূহানের বন্ধু। তবে বয়সে একটু বড়ো।
-স্বাগত নূহান। এই অসময়ে ‘ডিএইচ বিস্কুট’ খাচ্ছ কেনো? কি নিয়ে এতো বিরক্তি শুনি?
-হারুতাসি, আমি বেশ চিন্তিত। আমি আশা করি বিষয়টা নিজের চোখে দেখলে তুমিও চিন্তিত না হয়ে পারবে না।
এটা বলে নূহান বিজ্ঞানী হারুতাসিকে নীল পানীয়টা দেখাতে গেলো। আবার সেই নীলচে আলোপ্রভা দেখে এবার নূহান পাশের রোবটটাকে বলল, ‘দয়া করে আলোপ্রভাটা এখন বন্ধ করা যায় কি?’
‘অবশ্যই নূহান’,যান্ত্রিক গলায় এটা বলে রোবটটা আলোপ্রভা নেভাতে চলে গেলো।
নীল পানীয়টা দেখে হারুতাসির হাস্যোজ্জল মুখটাও কেনো জানি ফ্যাকাসে হয়ে গেলো।
এই পানীয়টা তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকদিন হলো। অদ্ভুতুড়ে এই পানীয় র‍্যাপিড ট্রান্সলেশন করতে পারে। প্রতি মুহূর্তে কোটি কোটি প্রোটিন এনে জমা করছে কোষের ভেতরে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এই প্রোটিনগুলো এমিনো এসিড না হয়ে এনার্জি হয়ে যায়। ফলে মানুষ খুব তাড়াতাড়ি হারানো এনার্জি আবার ফেরত পেতে পারে। অনেক আগে মানুষ নাকি কার্বনেটেড ওয়াটারের সাথে ‘সিনাডোট্রোপিন’ মিশিয়ে পান করত। ওগুলোর নাম ছিলো এনার্জি ড্রিংক। অনিয়ন্ত্রিত ওই পানীয় মানুষের হরমোনাল সাইকেল নষ্ট করে দিতো। বোকা মানুষগুলো না বুঝেই পান করত ওগুলো। পরেরদিকে যখন মানুষ জানতে পারল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কোনো কোনো অঞ্চলে বংশগতি একেবারে থেমেই গেলো।
কিন্তু এতোদিন পরে স্বাস্থ্যসম্মত এই উত্তেজকও যে চিন্তার কারণ হবে কে জানত?
-ওগুলো কি দেখছি আমি? তুমি কি আগেই এগুলো দেখতে পেয়েছ?
-খুব বেশি আগে নয়।স্টেট মিউজিয়ামে রাখা নমুনার সাথে একদম মিল নেই।
-আরো একবার মিলিয়ে দেখবে?
-ঠিক বলেছ। এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে। স্টেট মিউজিয়ামের কিউরেটর ড. শিপরির সাথে কথা বলা দরকার।
ব্যস, নূহানের চোখের রেটিনা সেন্সর করে মুহূর্তেই হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে ভেসে উঠল এক লম্বা ,চিকন আর চিনচিনে গলার শিপরি।
-ড. শিপরি, তোমার কাছে যেই নমুনাগুলো আছে তার একটা ল্যাবে পাঠাবে।
-অবশ্যই মহামান্য নূহান, আমি কি জানতে পারি বিষয়টা কি?
-এক্ষুনি না। বিজ্ঞান কাউন্সিল ব্যাপারটা গোপন রাখতে চাইছে। তোমার মাইক্রোবসগুলোর বি-৪৬ নমুনাটা আমাদের দরকার। পরে আরেকটা ক্লোন করে নিবে।
এটুকু বলেই সংযোগটা বিচ্ছিন্ন করে দিলেন বিজ্ঞানী নূহান।
আর এদিকে অনেকদিন বাদে একটা জায়গায় কার্বনের স্তর কিছুটা পাতলা হয়েছে। সেখান থেকে টমেটোর মতো নির্জীব সূর্য দেখা যাচ্ছে। সেটা দেখতে মানুষেরা স্পেস সেন্টারের সামনে জড়ো হয়েছে। বেচারা রোবটগুলো হা করে মানুষের দিকে চেয়ে আছে, যেনো যা কিছু হচ্ছে তার কিছুই টের পাচ্ছে না তারা।
(২)
আজ স্কুলে রাশিকের একটা প্রজেক্ট দেবার কথা। সকাল থেকেই তাই প্রচন্ড রকমের তাড়াহুড়া আর উত্তেজনা এসে ভর করেছে রাশিককে। আজকে সে একা একাই ঘুম থেকে উঠেছে। গোবেচারা ধরণের রোবটটা আজকের কর্মসূচী সম্পর্কে জানে। সে নিজ ভঙ্গিতে কেমিকেল দিয়ে বানানো বোঁটকা গন্ধওয়ালা কফি, কিছু পরিমাণ গ্লুকোজ ক্রিস্টাল আর এক টুকরো ‘এলবুমাস’ জেলি টেবিলে সাজিয়ে রাখল।
-রাশিকসোনা, তোমার খাবারটা খেয়ে যেতে ভুলবে না।
-হ্যাঁ, অবশ্যই। তুমি কি জানো আজকে আমি একটা খুব মজার প্রজেক্ট দেব?
-জানি রাশিকসোনা।
-তা তো জানবেই। কিন্তু তাও আমি আবার তোমাকে বলব। আমার প্রজেক্ট ‘ভিনগ্রহী’দের নিয়ে। আগের মানুষ যাদের এলিয়েন বলত। জানো অনেক বছর আগে একবার………
রোবটের কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারে এমন শত শত তথ্য আছে। কিন্তু তারপরও রোবটটা রাশিকের কথাগুলো অবাক হয়ে শুনছিলো। এমন সময় স্কুলের ফ্লাইং ডেকার এসে হাজির।রাশিক বেরুতে যাবে এমন সময় দেখা গেলো টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। চকচকে মোটা সিলিকন ফয়েলের রেইনকোট টা নিয়ে রোবটও প্রায় মূহুর্তেই চলে এলো।
-রাশিকসোনা, আজকের বৃষ্টির পিএইচ খুব কম। ২ এর নিচে। তেজস্ক্রিয়তাও খুব বেশি। সাবধানে থাকবে। তুমি কিন্তু অবশ্যই ‘এক্টিভেটেড আয়োডিনে’র ক্যাপসুলটা নেবে।
-চিন্তা করো না, আমি নিয়েই নিয়েছি।
এই বলে রাশিক ফ্লাইং ডেকারের ভেতর ঢুকে গেলো। রোবটটা হাত নাড়িয়ে ওকে বিদায় জানালো।ডেকারটা চলে না যাওয়া পর্যন্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকল। অজানা আশংকায় তার ‘কেমনজানি’ লাগতে লাগল। ধীরে ধীরে কি তাহলে ওর আবেগ এসে যাচ্ছে? মানুষের মতো? কি মারাত্মক!
কিছুক্ষণ পর স্কুলের ফ্লাইং ডেকারের পাঁচ নম্বর সিটে রাশিককে বসে থাকতে দেখার কথা ছিলো। কিন্তু দেখা গেলো, রাশিক হঠাৎ মুখভর্তি করে বমি করে দিয়েছে।অক্সিজেন হুডটার সামনের স্বচ্ছ কাঁচটা ঘোলা হয়ে গেছে। সবকিছু ঘোলা দেখছে সে।চেতনা হারাচ্ছে বলে মনে হলো। ডেকারটার তত্ত্বাবধায়নে থাকা মোটামুটি বুদ্ধিমান ধরনের রোবটটা নিশ্চিন্ত মনে ধীর গতিতে রাশিকের কাছে এসে থামল। স্কুলে পৌঁছাতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড লাগার কথা। এর মধ্যেই রাশিকের চেতনা লোপ পেয়ে যাচ্ছে। বলতে বলতে ডেকারটা স্কুল কম্পাউন্ডে এসে গেলো।
এরপর সবকিছু যেন খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো। রাশিককে ‘স্টেট হাসপাতালে’ পাঠানো হলো মুহূর্তেই। সংকেত পাঠানো হলো রাশিকের নীল রঙের চোখওয়ালা রোবটটার কাছে।টাচস্ক্রীন যুগে মানুষ ফার্স্ট এইড বলে একটা জিনিস শিখেছিল। এখন আর সেই ঝামেলা নেই। মুহূর্তেই হাসপাতালে পৌঁছানো যায়।
কয়েক মুহূর্ত পরেই রাশিকের লাল রঙের ফ্লাইং ডেকার এসে থামল ‘স্টেট হাসপাতালে’র সামনে। গোবেচারা ধরণের রোবটটা ঢুকল হাসপাতালে।
(৩)
মেডিকেল কলেজে বেশ ভালো ফল করেছিলেন বলে সরাসরি এই হাসপাতালে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন ডাঃ সেমন্তি। এই কয়েক বছরে বিশেষ কোনো জটিল রোগের চিকিৎসা তাকে করতে হয়নি। রাশিকের দায়িত্ব তার হাতে।রাশিকের রক্ত নেওয়া হয়েছে কিছুক্ষণ আগে।ল্যাবে রক্তের স্যাম্পলটা নিয়ে বারবার পরিক্ষা করেও সমস্যাটা ধরে উঠতে পারছেন না তিনি। রক্তে যাদের দেখা যাচ্ছে তারা কেউ চেনাজানা কেউ না। সবাই অন্যরকম এক অণুজীব। ডাঃ সেমন্তির কোর্সমেট ডাঃ রুবাই আর মাইক্রোবস বিশেষজ্ঞ ডাঃ সৌরভ অনেক ভেবে স্যাম্পলটা বিজ্ঞান কাউন্সিলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলেন।ব্যস, রেটিনা স্ক্যান করে সাথে সাথেই হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে দেখা গেলো বিজ্ঞানী নূহান আর হারুতাসিকে। অনেকক্ষণ ধরে নানা পরিক্ষা করে তারা কিছুক্ষণের জন্য মিউজিয়ামের কিউরেটর ‘শিপরি’কেও যুক্ত করে নিলেন।
আর ওদিকে রাশিকের হাত ধরে বসে আছে নীল রঙ চোখের সেই গোবেচারা রোবটটা।অদ্ভুত সব চিন্তা হচ্ছে রোবটটার।
টাচস্ক্রীন যুগের মানুষেরা ইন্টারনেটের নেশায় মেতে উঠেছিল। নিজেদের সন্তানদের জন্ম নেওয়ার আগেই বিশেষভাবে গ্যাস্ট্রুলেশন করে জমা রেখে দিয়েছিলো তারা। নিজেরা শেষমেশ আইএডি (ইন্টারনেট এডিকশন ডিসঅর্ডার) তে মারা গিয়েছিলো। থেকে গিয়েছিলো সেই গ্যাস্ট্রুলা গুলো।বিজ্ঞান কাউন্সিল সেগুলোর দায়িত্ব দিয়েছিল রোবটদের।গত পনের বছর থেকে রাশিকের এই দায়িত্ব পালন করে আসছে রোবটটা। রোবটটার মন খারাপ লাগে। এই ছেলেটা ওর সাথে কতো দুষ্টুমি করেছে! কতো মজা করেছে! যখন রাশিকের মনে হতাশা আসতে চেয়েছে তখনই রোবটটা নিয়ম করে রাশিকের সারা গায়ে কাতুকুতুর অনুভূতি জাগিয়েছে। আজকে সব কেনো জানি রোবটটার মনে পড়ছে।
তিনদিন পর রাশিকের শরীরে ওষুধ দেওয়া হলো।ডাঃ সেমন্তি আর বিজ্ঞান কাউন্সিলের বিজ্ঞানীরা অনেক কষ্ট করে বের করেছেন যে ঐ নীল রঙের উত্তেজক পানীয়তে নূহান যেই অণুজীবগুলো দেখেছিলেন তারা রাশিকের রক্তের অনুজীবের সাথে মিলে যায়। শিপরি জানিয়েছেন যে মিউজিয়ামে রাখা হারিয়ে যাওয়া প্রাণি ‘বনরুই’র ডিএনএ এর নকশা দিয়ে কিছু একটা করা সম্ভব। শিপরির জ্ঞান দেখে নূহান বাহবা দিয়েছেন। সত্যিই বনরুই এর ডিএনএ স্যাম্পল দিয়ে ওষুধটা বানানো গেছে। হয়ত বনরুই গুলো বেঁচে থাকলে এমন রোগ হতোই না কারো।
ক’দিন পর রাশিক সেরে ওঠে।উঠে বসতে পারে, হাঁটাচলা করতে পারে।একদিন হঠাৎ রোবটটা রাশিককে বুকে জড়িয়ে ধরে। রোবটটা বলে ওঠে, ‘রাশিকসোনা, টাচস্ক্রীন যুগে ফেরত যেতে পারলে একটাও বনরুই মারতে দিতাম না’। রাশিক মুচকি হাসে। খানিকবাদে রোবটটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়, যন্ত্রের না আবেগ থাকতে নেই!আবেগ এসে যাচ্ছে তো, কি মুশকিল!
বিজ্ঞানী নূহানদের এতো সময় কোথায়? মাত্র খবর এসেছে যে স্পেস স্টেশন অদ্ভুত এক সিগনাল রিসিভ করেছে। মনে হয় ভীনগ্রহীরা এবার সাড়া দিয়েই দিল।খবর পেয়েই সেদিকে ছুটলেন তারা। তারপর কি হলো সেটা না হয় পরেরবার বলা যাবে!!