অনিঃশেষ অন্ধকার


Admin প্রকাশের সময় : ০২/০৩/২০২০, ৬:১২ PM
অনিঃশেষ অন্ধকার

এস.এম. মানজুরুল ইসলাম সাজিদ (১৬), বাগেরহাট:
পাঁচজনের ছোট্ট একটি পরিবার। যেখানে আছে তিলু, নিলু ও মিলু। মা গৃহিনী, বাবা করেন ব্যাংকে চাকুরী।তিন ভাইবোনদের মধ্য মিলু সব থেকে ছোট। এজন্য সব থেকে আদরের মিলু । কিন্তু অন্য দুইভাইবোনের মধ্যে মিলুর আচারণ অন্য রকম। সে ছিল তৃতীয় লিঙ্গের। সে ছোট বেলায় ছেলের মত থাকলেও মেয়েদের মত চলাচল করতে পছন্দ করত। বয়স তখন ৯-১০ তখনই মিলুর মা বাবা ভাই বোন সবাই জানে সে তৃতীয় লিঙ্গের। এজন্য বড় হতে থাকে আর তার আদরও কমতে থাকে। এভাবে সে সমাজে হয়ে ওঠে হিজড়া। বাসার বাইরে গেলে লোকে বলতো হিজড়া আইছে, তার পরনের পোশাক ধরে টান দিত। আস্তে আস্তে সে বড় হয়ে ওঠে, আর সাথে বয়ঃসন্ধীকাল পরিবর্তনের ফলে তার মধ্যে মেয়েদের হরমোন, মেয়েদের চরিএ ফুঠে উঠতে থাকে। তার মধ্যে সেও নিজেকে নারী ভাবতে শুরু করে। বাজার থেকে নারীদের পোষাক কিনে আনে, তার ঠোঁটে লিপিস্টিক দেয়। বাবা তাকে দুচোখে দেখতে পারে না,বলে, তুই আমার মান সম্মান নষ্ট করেছিস,হিজড়া, মুখ দেখলেও অমঙ্গল হয়,এই বলে সারাদিন গালাগালি করে। ভাইবোন সবাই তাকে অবহেলার চোখে দেখলেও, মা মিলু তাকে খুব ভালোবাসে। মিলু কে সবাই গালাগালি দিলেও সে কাউকে কিছু বলতে পারে না,বলে না।এভাবে তার বয়স যখন ১১ বছর। পাশের গ্রামের হিজড়াপল্লীর সদস্যরা জানতে পারে মিলু একজন হিজড়া। আর হিজড়ারা কোন হিজড়া শিশু জন্ম গ্রহণ করলে তারা তাকে নিয়ে যায়। মিলু কথা টা জানতে পারে। তার পর থেকে মিলুর খুব ভয় হয়। একদিন রাতে তারা মিলু কে নিতে এসেছিল। মিলুর বাবা সে দিন বাসায় ছিল না।রাতে মিলুকে নিতে আসলে মিলুর মা মিলুকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখে। তাকে দিতে চায় না।হিজড়ার দল সেদিন চলে যায়।।মার কোলে মাথা রেখে মিলু প্রশ্ন করে, মা, ওরা আমাকে কেনো নিয়ে যেতে চায়? মা সান্ত্বনা দিয়ে বলে ‘ওরা মজা করছিল তোমাকে নিয়ে ‘।মিলুকে একথা বলে সে কান্না করতে থাকে।

মিলুর ভাই তিলু। সে এবার বিয়ে পাশ করেছে। চাকুরী হয়েছে।তার জন্যমেয়ে দেখা হচ্ছে বিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু পাত্রীর বাসা থেকে একটাই সমস্যার কথা বলে, যে, ওর ভাই হিজড়া বলে তিলুও হিজড়া হতে পারে। অনেক মেয়ে দেখলেও সবার একাটাই কথা।অনেক খোঁজাখুঁজির পর বিবাহের পাত্রী খু্ঁজে পাওয়া গেল। বিয়ে হল। হঠাৎ রাতে মিলু্কে নেওয়ার জন্য হিজড়ারা আসে। সেদিন মিলুকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। ওদের সাথে না যাওয়ার জন্য মিলু মায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। মাও হাত বাড়িয়ে দেয় কিন্তু মিলুর বাবা, ভাই,বোন মাকে আটকে রাখে। মা ভাত খায় না,কান্নাকাটি করে। মিলু কেমন আছে এ চিন্তায় কেটে গেল পাচঁটি বছর।মা মিলুর কোন খোঁজখবর পায় না।মিলুর বাবা জানত মিলু কোথায় থাকে, কিন্তু মিলুর মা যাতে যেতে না পারে এজন্য ঠিকানা গোপন রাখে।এদিকে মিলুও বাসার ঠিকানা ভূলে গেছে।

আর মিলুর মেজবোন নিলু সে এবার ইন্টারপাশ করেছে।তাকেও বিয়ে দেবে, এজন্য পাত্র দেখা হচ্ছে।কিন্তু তার পরিবারে হিজড়া আছে বলে। কোন পাত্র ই রাজি হয় না।এদিকে মিলুর বাসায় যাওয়ার জন্য খুব মন কাঁদে।কিন্তু বাসার ঠিকানাটা হারিয়ে যাওয়ায় সে আর বাসা খুঁজে পায় না। এভাবে কেটে যায় দশটি বছর। তার মন কাঁদে মাকে দেখার জন্য। বাসার ঠিকানা খুঁজতে থাকে সে। খুঁজতে কেটে যায় অারও ৬ টি মাস।অবশেষে সে বাসার ঠিকানাটি পায়। কিন্তু তখন ছিল সকাল। সকালে ঢুকলে মানুষ দেখে ফেলবে, হয়তো তাকে মারতেও পারে। সে ভাবতে থাকে।

এদিকে তার পরিচয় হয় এক নিঃসন্তান মায়ের সাথে তিনি রাস্তায় ভিক্ষা করেন। তিনি মিলুকে খুব আদর স্নেহ করে ভালবাসে তাকে ভাত খাইয়ে দেন কিন্তু নিজ মায়ের যে ভালোবাসা সেটি আসলে কখনো পূরণ হয় না। হঠাৎ একদিন রাতে সে তার নিজ বাসার সামনে যায়।।তখন রাত দুইটা, দারোয়ান ঘুম, সে তার চোখ ফাঁকি দিয়ে, চলে যায় দোতলায়, তার বাসায়। কলিং বেল টিপলে, সাথে সাথে তার বড় ভাই এসে দরজা খোলে এবং খুলেই তাকে গালাগালি করতে থাকে। তুই কেন আমার বাসায় আসিস? আমার সম্মান হানি হয়। তোর জন্য আমার বিয়ে হতে অনেক কষ্ট হয়েছে।এসব কথা বলে তাকে খুব মারধর করতে শুরু করে। মিলু মা মা- বলে ডাকতে থাকে। কিন্তু নিজ শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেও সে মিলুর বাবা ও বড় ভাইয়ের কারণে মিলুর কাছে আসা হয়না তার। মিলুর বাবাও বলে, তুই আমার বাসায় এসেছিস কেন? আমার মান-সম্মান সব যাবে। তুই হিজড়া। বাসা থেকে বের হ। মিলু তার মায়ের কাছে আসতে চায়। কিন্তু তার অার অাসা হয় না। মিলুর ভাই পা থেকে জুতা খুলে তাকে খুব মারধর করে। মিলু মা মা- বলে চিৎকার করতে লাগল এক পর্যায়ে তিলু চলে যায়এবং দারোয়ানকে হুমকি দিয়ে যায়, এই সমস্ত বাজে লোকজন কীভাবে বাড়িতে ঢোকে? তোর চাকরি যাবে, বলে সে চলে যায়। মিলু অনেক সময় কান্নাকাটি করে চলে যায় তার সেই নি:সন্তান মায়ের কাছে। বলে- মা, কী যে ক্ষুধা লেগেছে, আমাকে কটা ভাত দাও মা। নিজ হাতে ওই মা তাকে ভাত খাইয়ে দেয়।

এভাবে কেটে গেছে অনেক বছর । কিন্তু তার নিজ মায়ের কাছে মায়ের ভালোবাসা পাওয়া, চুমু দেয়া, তার কাছে অধরাই রয়ে যায়। সে যে হিজড়াদের কাছে থাকে, তারা তাকে দিয়ে বিভিন্ন সময় চাঁদা, বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা অানা এসব কাজ করায়। মন থেকে তার এসব কাজ খুব খারাপ লাগে। তার খারাপ লাগে, সে হিজড়া বলে তাকে কেউ চাকরি দেয় না। তাকে কেউ কর্মচারী রাখেনা। কিন্তু তাহলে কী করবে সে? এজন্য বাধ্য হয়ে পেটের টানে এসমস্ত কাজ করে। হঠাৎ একদিন তার মা মারা যায়, সে মায়ের লাশ দেখতে গেলে, তাকে লাশ দেখতে দিতে চায় না, শুধু সে হিজরা বলে। অনেক কষ্ট করে লাশ দেখেলও সেদিনও তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। সে মাকে শেষবার একটু স্পর্শ করার চেষ্টা করে এবং মাকে যখন মাটি দিতে নিয়ে যাচ্ছিল ওখানেও তার ভাই এবং বাবা তাকে লাঠি নিয়ে ধাওয়া করে যাতে সেএই লাইনে এবং জানাজায় অংশগ্রহণ করতে না পারে। শেষে কবরে যখন দেওয়া হয় তার মাকে তখনও তাকে কবরে একটু মাটি দিতে দেওয়া হয়নি। কারণ তার বাবা, ভাই ও এলাকাবাসীর ধারণা যে, হিজড়া কবরে মাটি দিলে অমঙ্গল হবে। হিজড়া হয়ে জন্মানোয় নিজেকে সে অভিশপ্ত মনে করে।
মায়ের কবরে মাটি দিতে না পেরে মিলু এলাকা ছেড়ে, সাথের হিজরাদের ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।