একটু
বাদেই বেশ দামী একটা কালো কুচকুচে গাড়ি এসে থামল৷ গাড়ির ড্রাইভার শশব্যস্ত হয়ে ছেলেটার কাঁধ থেকে ব্যাগ নিল, পেছনের সিট’টাতে রাখতেই গাড়ির একটা দরজা খুলে উঠে পড়ল ছেলেটা৷ ভেতরটা বুঝি বেশ ঠান্ডা। গাড়িতে ঢুকতেই ছেলেটা বেশ স্বস্তি পেল বলে মনে হল৷ খানিক পরে গাড়ির ভেতর বেশ জোরে গান বাজতে লাগল৷ একটা সময় মহাসড়ক ধরে সাঁই সাঁই করে এগিয়ে চলল গাড়ি, মিলিয়ে গেল হাজারো গাড়ির ভীড়ে৷দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিল পুচকে
একটা ছেলে৷ বয়স কত হবে? এগারো কি বারো বছর৷ নাম রকি৷ ওর কাঁধে ব্যাগ নেই৷ হাতে কোল্ডড্রিংকস্ও নেই৷ এও একটা গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, তবে, সে তার যাত্রী নয়৷ আবার, এ গাড়িটা ঐ কালো গাড়ির মত আয়েসি নয়৷ এর ভেতরটা ফাঁকা, এখানে গান বাজে না৷ তবে এটারও চার চাকা, স্টেয়ারিংও আছে৷ যাত্রীদের বসার জন্য আছে ফোম বসানো নরম সিট৷ মাঝে মাঝে রকির সাধ জাগে, সিটগুলোয় বসে দূরে কোথাও চলে যাবে, কিন্তু শেষমেশ তা হয়ে ওঠে না৷গাড়িটার নাম ‘লেগুনা’৷ যাত্রী বহন করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়৷ জাহাজের যেমন খালাসি থাকে, নৌকার মাঝি, বাসের হেল্পার তেমনি রকি হচ্ছে এই ‘লেগুনা’র হেল্পার৷ যিনি এই গাড়িটা চালান, তাকে ‘ওস্তাদ’ বলতে হয়৷ রকি গাড়ির পেছনের দিকটাতে ঝুলে ঝুলে যায়৷ ব্যাপারটা বেশ বিপদজনক, কিন্তু রকির এতে কোনো অসুবিধাই হয় না৷ মাঝে মাঝে গাড়ির গায়ে শক্ত করে থাপ্পড় বসিয়ে সিগন্যাল দেয়৷ প্রাণবন্ত সে৷ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে যাত্রী ডাকে৷
তবে আজ স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে রকি’র খুব অন্যরকম লাগছে৷ সাদা ধবধবে শার্ট পরে,চুল আচঁড়ে, কি পরিপাটি হয়ে সবাই স্কুলে এসেছে৷ সবাই ওর মত৷ এদের মাঝে নিজেকে খুব বেমানান লাগে৷ পরনে বিবর্ণ জামা, পকেট-ছেঁড়া প্যান্ট, চুল এলোমেলো৷ লজ্জায় একেবারে নুইয়ে পড়ে রকি৷ গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আবার যাত্রী ডাকতে শুরু করে৷
সেদিনের সন্ধ্যা৷ রকি ক্লান্ত দেহে রাস্তার
একটা পাশে হেলান দিয়ে বসে আছে৷ সূর্য ডুবেছে কিছুক্ষণ আগে৷ লাল আভায় চারদিক ভরে গেছে৷ যাকে বলে -‘গোধূলি’৷ রকি’র মনে হাজার রকমের কল্পনা দানা বাঁধছে৷ স্কুল, কুচকুচে কালো গাড়ি কিংবা বিস্তৃত নদীর বালিময় চরে ‘ঘুড়ি-লাটাই’ নিয়ে ছুটোছুটি–সবকিছু৷ সব কল্পনা কেন জানি ওলট-পালট হয়ে জট পাকিয়ে যায়৷ একটা প্রশ্ন তাকে বারবার জিগ্গাসিত করে তোলে–‘কবে সে ছুটি পাবে!’আমাদের কালো কুচকুচে গাড়ির গান শোনার ছেলেটাও ছুটির কথা ভাবছে৷ সামনে গরমের ছুটি৷ কি মজা হবে৷ বন্ধুদের নিয়ে ‘মুভি পার্টি’ করা যাবে৷
একটা সাইকেল রেস হলেও মন্দ হয় না৷ বিকেলে রেস্টুরেন্টে তো যেতেই হবে৷ ভাবছে প্রাইভেটগুলো বাদ দিলেও মন্দ হয় না, কিন্তু স্যার-ম্যাডামদের ভরসা নেই, ঠিক বাবা-মা কে সব জানিয়ে দেবে৷তবে রকির ছুটি আলাদা রকমের৷ ছুটিটা আদৌ তার জন্য আনন্দের হবে কিনা সে জানে না৷ ছুটিতে বেশ খানিকটা টাকা পাওয়া যাবে৷ এইবার ব্যবসাটা বেশ জমেছে৷ ওস্তাদ মনে মনে খুব খুশি৷ হয়ত বোনাসও দিয়ে দিবে৷ ভাবতে ভাবতে কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারে নি৷
পরদিন ঠিক দুপুর বেলায় চুপচুপ করে স্কুলের সামনে চলে এসেছে সে৷ সে দেখে, আজ অনেক গাড়ি ৷ সাদা, কালো,লাল,বেগুনি–কত রংয়ের৷ এর মাঝে ঐ সেদিনের কুচকুচে কালো গাড়িটা সে খুঁজতে থাকে৷ না, খুঁজে পায় না সে৷ দেখে ওর বয়সী ছেলেমেয়েরা হাতে কোল্ডড্রিংকস্ নিয়ে গাড়িতে উঠছে৷ এবার একজন নয়, অনেকে৷ প্রায় সবকটি গাড়িতেই গান বাজছে৷ সবকটিই সাঁই সাঁই করে চলছে রাস্তা দিয়ে, মহাসড়ক দিয়ে আর মিলিয়ে যাচ্ছে অনেক গাড়ির ভীড়ে৷
লেগুনার স্টেয়ারিং মাঝে মাঝে ধরে রকি৷ মুখ দিয়ে গুনগুনিয়ে গান করে৷ ভাবে এইতো গান বাজছে গাড়িতে৷ জানালা দিয়ে বাতাস ঢুকলে ভাবে ঠান্ডা হাওয়া, ঠিক ঐ গাড়িগুলোর মত৷ আর ক’দিন পরে হয়ত মহাসড়ক ধরে সেও তার লেগুনা চালাবে৷ সাঁই সাঁই করে চালাবে৷ পার্থক্য শুধু–‘কোনোদিন স্কুলে যাওয়াটা হবে না৷’
আজকের সন্ধ্যেটা বেশ গরম৷ রকি শার্ট খুলে একপাশে রেখে দেয়৷ আজ গোধূলি নেই৷ ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ মনে হয় চাঁদ দেরিতে উঠবে৷ দুটো ডালভাত খেয়ে নিয়েছে রকি৷ এবার ঘুমিয়ে পরতে হবে৷ আরেকটা দিন হাতছানি দিয়ে ডাকছে৷ পরশু ছুটি হবে৷ রকি বাড়ি যাবে৷ ছোট্ট ভাইবোনদুটো নিশ্চয়ই বেশ বড় হয়ে গেছে৷
এদিকে মস্ত বড় বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে কুচকুচে কালো গাড়ির ছেলেটা ভাবছে—
”ইশ্! কি সুন্দর জোনাকি!
আপনার মতামত লিখুন :